নেতাজির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আজও থামেনি, কারণ যে ‘ হরির লুঠে ‘ র বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তা আজও চলছে

Main দেশ বিদেশ রাজ্য
শেয়ার করুন

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস-কে নিয়ে আলোচনা-বিতর্কের শেষ নেই। তাই ১২৫ বছর পরও তাঁকে নিয়ে ভারতবাসীর উৎসাহ-আবেগে এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। শুধু একটাই খেদ- তা হল, এত বছর পরেও নেতাজির মৃত্যু ঘিরে বিতর্ক আজও রয়ে গেল। তাঁর পরাক্রম, বীরত্ব, আদর্শ এসব নিয়ে আমরা গালভরা কথা বললেও আজও তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হল না। দেশ স্বাধীন হলেও নেতাজি দেশে ফিরলেন না নাকি তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হল না। নেতাজিকে কেন এত ভয় ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি আমরা। সংবাদ প্রভাকর টাইমস তাই অনুসন্ধানমূলক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। আজ তাঁর ষষ্ঠ পর্ব।
(পাঠকদের জানিয়ে রাখি ‘নেতাজিকে কেন এত ভয়’ শীর্ষক অনুসন্ধানমূলক ধারাবাহিকটি আমরা আজ আপাতত সমাপ্ত করছি। তবে আমাদের অনুসন্ধান চলছে। খুব শীঘ্রই আমরা আবার আপনাদের কাছে জনপ্রিয় এই প্রতিবেদনটি পুনরায় শুরু করব। জয় হিন্দ)
Published on: জানু ২৮, ২০২১ @ ১৫:৫০
লেখক- সুমিত গুপ্ত 

পর্ব-ষষ্ঠ

ড. পবিত্র মোহন রায়। তিনি ছিলেন নেতাজির একনিষ্ঠ অনুগামী। ১৯৫৬ সাল। ড. রায় গুমনামী বাবার সঙ্গে দেখা করে এসে নেহেরুকে চিঠি লিখলেন, যদি আজ নেতাজি হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করেন, ভারত সরকার কি তাঁকে যুদ্ধ অপরাধী হিসেবে ব্রিটিশ-মার্কিনীদের হাতে ধরিয়ে দেবে? তাঁকে কিভাবে গ্রহণ করবে সরকার? চিঠির জবাব দিলেন খোদ নেহেরু। অতি শীতল সে চিঠির জবাবি ভাষ্য। নেহেরু লিখলেন, ‘আপনি ভাবলেন কি করে, সুভাষকে আমরা ধরিয়ে দেব! সুভাষ আত্মপ্রকাশ করলে সরকার তাঁকে যোগ্য সম্মান দেবে।’

ড. রায় ভেবেছিলেন নেহেরু চমকে উঠে হয়তো জানতে চাইবেন,’কোথায় সুভাষ?’ বাস্তবে কিন্তু ঘটলো ঠিক উল্টো। নেহেরুর জবাবে ফুটে উঠলো জটিল এক স্ববিরোধীতা। যে মানুষ এতদিন জোর গলায় দাবি করে এসেছেন, বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজি মৃত, সেই তিনি যেন ঘুরিয়ে স্বীকার করে নিলেন, নেতাজি যে জীবিত তা তিনি ভালো মতোই জানেন।হয়তো তাঁর জবাবে প্রচ্ছন্ন এক আগ্রাসনও লুকিয়ে ছিল। হয়তো সেই জবাবের মধ্য দিয়ে সুভাষের কাছে তিনি এই বার্তাই পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন, ক্ষমতা থাকে তো প্রকাশ্যে এসে দেখাও। নেহেরুর এই মন্তব্যে আর কিছু প্রমাণ হোক আর নাই হোক, একটা সত্য দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট, নেতাজি কোথায়, কি অবস্থায় রয়েছেন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাই বা তাঁর কি, তা তাঁর সঠিক জানা ছিল না।

এমনকি সুভাষকে নিয়ে প্রবল স্নায়ুর চাপেও ভুগতেন তিনি। পাঠকদের মনে করিয়ে দিই- এ হলো সেই বছরেরই ঘটনা যে বছর রুশ-ভারত মৈত্রীচুক্তি’ সাক্ষরিত হয়েছিল। এ হল সেই বছরও, যে বছর শাহনাওয়াজ খান কমিটিকে নেতাজিকে যেন তেন প্রকারে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত প্রমাণ করার গুরুদায়িত্ব অর্পন করেছিলেন নেহেরু। ঘটনা – পরম্পরার কি আশ্চর্য সমাপতন!

ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদারকে ভারতের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করার কাজ দিয়েছিলেন নেহেরু। প্রচুর পরিমান করে কয়েকটি খণ্ডে ভারতের ইতিহাসের গ্রন্থ রচনা করেছিলেন রমেশবাবু। গ্রন্থটি পত্রপাঠ বাতিল করেছিলেন নেহেরু। রমেশবাবুর অপরাধ, নেতাজির আইএনএ-র বীরগাথা অকপটে গ্রন্থে ঠাঁই দিয়েছিলেন তিনি। ইতিহাস রচিত হয় বিজয়ীর ইচ্ছেয়, তারই মহিমাকীর্তনের লক্ষ্যে। ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয় না। ভারতের ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় মুছে দেওয়া হল সুভাষকে। কিন্তু কালের খেলা অতি বিচিত্র। সে কারোর নয়।

আবারও সেই ১৯৫৬ সাল। কলকাতায় এক সরকারি সফরে এলেন প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলি। বাংলার তৎকালীন গভর্নর ফণীভূষণ চক্রবর্তীর কাছে রাজভবনে এসে উঠলেন তিনি। রাজভবনে মধ্যাহ্নভোজের পর নানা বিষয় আলোচনা হচ্ছে এটলির সঙ্গে ফণীবাবুর। কথায় কথায় গভর্নর এটলিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের ভারত ছাড়ার পিছনে গান্ধী-কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলনের কি ভূমিকা?” এটলির সংক্ষিপ্ত জবাব,” মি-নি-স্যা-ল!” এবার ফণীবাবুর দ্বিতীয় সওয়াল,’ তবে হঠাৎ আপনারা ভারত ছাড়লেন কার জন্য?” এটলির সপাট জবাব, “বোস…!”

ফণীভূষণ-এটলির এই কথপোকথনের নথি এতকাল গোপনই ছিল। সম্প্রতি সেটি প্রকাশ্যে এসেছে। মহাকাল হয়তো এভাবেই কথা বলে। শাসক তার রাষ্ট্রযন্ত্র আর ঐশ্বর্য্য দিয়ে ইতিহাসকে কিনতে পারলেও কালকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তার নেই। সুভাষ ছিল সেই ধূমকেতুর নাম। যে যুগান্তর ঘোষণা করে। ব্রিটিশরা বিচক্ষণ জাত। তারা সেটা টের পেয়েছিল। ভারতের আত্মাকে পিষে মেরে, তার আত্মমর্যাদাকে চূর্ণ করে চিরকাল কায়েমী শাসন বজায় রাখতে চেয়েছিল ইংরেজ শাসকরা। তারা বুঝেছিল ভারতের ভারতের সুপ্রাচীন সভ্যতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি বিজ্ঞানের গভীরতা আর ব্যাপ্তিকে। তারা জানত, ঘুমন্ত এই দৈত্য যদি একবার জাগে ইউরোপের খণ্ড-সংস্কৃতি খকুটোর মতো প্লাবিত হয়ে যাবে। তাই শুধু ধনসম্পদ নয়, তারা নির্বিচারে লুঠ করেছিল ভারতের সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থ। প্রাচীন লোকাচার, শিক্ষা, চিকৎ্সা, শাস্ত্র যোগ-আয়ুর্বেদ, ধাতুবিজ্ঞান, গণিত আর প্রাচীন মহাকাশ বিদ্যার দুষ্প্রাপ্য পুঁথি ও নথি।

তারা কখনোই চায়নি ভারত স্বমহিমায় জেগে উঠুক। ভারতের সবকিছুকে হীণ প্রতিপন্ন করতে বিশাল এই মহাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করেছিল তারা ভারতেরই জাতিতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব আর ভাষাতত্ত্বকে জোর করে অধোগামী, অর্বাচীন আর পরাশ্রয়ী প্রমাণ করতে পশ্চিমী সংস্কৃতি-শিক্ষাকে জোরজবরদস্তি চাপিয়ে দিয়েছিল দেশবাসীর ঘাড়ে। একটা সুসমৃদ্ধ জাতিকে দু’শো বছরে ধ্বংস, দারিদ্র্যের শেষ কিনারায় এনে দিয়েছিল। আমদানি করেছিল মন্বন্তর আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো অভিশাপ। বংশানুক্রমে শোষণ-শাসনের প্রয়োজনে এসবের বড়ই প্রয়োজন ছিল তাদের।

ব্রিটিশরা জানত, শারীরিক পীড়নের চেয়ে মনস্তাত্বিক নির্বীজকরণে কাজ দেয় অনেক বেশি। ইউরোপীয়দের সেই মতলব ধরে ফেলেছিলেন সুভাষ। তাদের দুশো বছরের চক্রান্তের গোড়া ধরে টান দিয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতার অর্থ তাঁর কাছে স্বাধীনতাই ছিল ডোমিনিয়ন নয়। দেশপ্রেম একটি বোধের নাম। আর স্বাধীনতা তার বোধীমন্ত্র। সুভাষ দেশবাসীকে সেই সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন।

স্বাধীন ভারতের অগ্রগতির সুস্পষ্ট এক স্বচ্ছ পরিকল্পনা ছিল তাঁর। সেই স্বচ্ছতাই তাঁকে কংগ্রেসের সমস্ত নেতাদের থেকে ভীষণভাবে আলাদা করে দিয়েছিল। সেই স্বচ্ছতাই তাঁকে বাধ্য করেছিল দেশ ছাড়তে। সেই স্বচ্ছতার কারণেই সুভাষ হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশের একমাত্র শত্রু। শুধু ব্রিটিশই বা কেন, মধ্য-প্রাচ্যের তেল-সাম্রাজ্য, প্রাকৃতিক সম্পদে পূরণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পলিনেশিয়ার ভূখণ্ড, ভারত মহাসাগরে সামরিক আধিপত্যের প্রয়োজন ছিল আমেরিকারও। সুভাষ বোস তাদের কাছেও ছিলেন সমান বিপজ্জনক একটি নাম। হয়তো বা সোভিয়েত কিংবা লাল চিনের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক ছিলেন তিনি। সেই কারণে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি ও তাদের ভারতীয় দোসররা কখনোই চায়নি নেতাজি আত্মপ্রকাশ করুন। তারা জানে, শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, সুদূর জাপান, পশ্চিম এশিয়া এমনকি রাশিয়াতেও আসম্ভব জনপ্রিয় নেতাজি।

আইএনএ, এশিয়ান  লিবারেশন ফ্রন্টের কর্মকান্ডের কথা আজও এই মহাদেশের ঘরে ঘরে রূপকথা হয়ে ঘোরে। জীবিত নেতাজির চেয়েও বিস্ফোরক তাঁর সেইসব রূপকাহিনি। তাই নেতাজির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আজও থামেনি। কারণ যে হরির লুঠের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, সে লুঠ আজও সমানে চলছে।অন্যভাবে অন্য চেহারায়। কাজেই যুদ্ধও চলছে। চলবে আবহমান কাল। আমাদের বিশ্বাস সত্য একদিন সামনে আসবেই।

Published on: জানু ২৮, ২০২১ @ ১৫:৫০


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

− 2 = 6