জলসংকটে সুন্দরবনঃ চিন্তিত বিজ্ঞানীরা দিলেন সমাধান সূত্র

এসপিটি এক্সক্লুসিভ দেশ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান রাজ্য
শেয়ার করুন

ভারতবর্ষে পানীয় জলের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে ভূ-গর্ভস্ত জলের থেকে।২/৩ অংশ চাষের জল।বৃষ্টির জলই কেবল প্রাথমিক পরিষ্কার বা ফ্রেশ ওয়াটার-এর উৎস- যা ঠিকঠাক সংরক্ষন না করার জন্য প্রতিনিয়ত জলসংকটে পড়তে হয় সারা দেশের মানুষকে।

 Published on: জানু ১৩, ২০১৯ @ ১৫:৪৬

সংবাদদাতা- ডা. সৌমিত্র পন্ডিত

এসপিটি নিউজ, সুন্দরবন, ১২ জানুয়ারিঃ দিনে দিনে মাটির তলার জলের পরিমান কমছে ফলে সারা দেশে শুধু নয় সারা বিশ্বে জলসংকটের পরিমান বাড়ছে। দেখা গেছে যে প্রতিবছর প্রায় তিন ফুট বা এক মিটার জলস্তর কিছু কিছু জায়গায় নেমে যাচ্ছে। যা বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।অন্যদিকে নানান ক্ষেত্রের ব্যবহৃত জলের পুনঃব্যবহারের সঙ্গে গৃহস্তের দ্বারা ভূগর্ভস্ত জলের সংক্রমণ- যা মানুষের জীবনে বিভীষিকা হয়ে পড়েছে। তাই ভারতবর্ষে জলের উৎস খোঁজার জন্য শুধু নয় আগামিদিনে এর সঠিক ব্যবহার নিয়েও চিন্তিত বিজ্ঞানী মহল। কিভাবে রক্ষা পাবে এই গোটা পৃথিবী। আমাদের দেশের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দিলেন এর সমাধানসূত্র।

একদিকে জনসংখ্যার ক্রমান্বতি, শিল্পের বিকাশ, কৃষির বিস্তার, প্রাণীপালনের অগ্রগতি-প্রতিটি ক্ষেত্রে যে হারে জলের চাহিদা বাড়ছে অপরদিকে জলের উৎস কমার ফলে বা জল অপচয়ের  ফলে যে অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে তা নিয়ে এখনই আমরা সচেতন না হলে জলকষ্টে ভুগতে হবে বিশ্ববাসীকে।

ভারতবর্ষের চিত্রটাও একই। দিনদিন জলের স্তর নিম্নমুখী কিন্তু কৃষি, শিক্ষা-প্রাণী পালনের যে যুগান্তকারী আবিষ্কার বা অগ্রগতি চলছে তাতে আরও জলের প্রয়োজন কিন্তু কোথা থেকে আসবে এই জল? কিভাবে হবে কৃষির সঙ্গে প্রাণীপালন? কিভাবে কৃষি ও শিল্পের ভিত্তি স্থাপিত হবে? – সর্বত্র জল চাই আর আমরা যে হারে জল অপচয় করছি বা জলের মধ্যে নোংরা- জঞ্জাল ফেলে তার গুণমান নষ্ট করে চলেছি তা্র ফলে আগামী দিনে মানুষের জীবনে সংকট তৈরি হবে-প্রকৃতির ভারসাম্য বা বাস্তুতন্ত্র ও বিঘ্নিত হতে চলেছে।

এর থেকে বাঁচার তাহলে উপায় কি

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের “জল ধরো-জল ভরো” প্রকল্পের যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ এই জলের সংরক্ষণ-ই হবে আগামীর জলের উৎস। যার ওপর নির্ভর করে চাষাবাদ, প্রাণীপালন ও মৎস্য চাষ প্রভৃতি হবে। ১)মানুষকে জলের গুরুত্ব বোঝাতে হবে-সচেতন করতে হবে। ২)জলের অপচয় রুখতে হবে। ৩)আরো বেশি গাছ লাগাতে হবে। ৪)বৃষ্টির জলকে সংরক্ষণের জন্য বড় খাল বা পুকুর খননের পর সিমেন্ট দিয়ে বাধাই করতে হবে।

জল সঞ্চয়, জলের পুনঃব্যবহার সম্বন্ধে মানুষকে আরও শিক্ষিত ও সচেতন করতে হবে। এই জলসঙ্কট নিয়ে ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হল এক বিরাট বিজ্ঞান সম্মেলন যেখানে মূলত-আলোচনার বিষয় ছিল।-“কৃষিতে জলের চাহিদা পূরণের ব্যবস্থাপনা ও পর্যবেক্ষণ”- এটির আয়োজন ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় গোসাবা ব্লকের, টেগোর সোসাইটি, রাঙাবেলিয়া প্রকল্পের সহযোগিতায়, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডিয়া-ইউকে- জল প্রকল্প- যার মূল উদ্দেশ্য হল ‘সুন্দরবন’ পৃথিবী বিখ্যাত ব-দ্বীপ যেখানে কৃষি ও প্রাণীপালন এবং মৎস্য চাষ মানুষদের জীবিকার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কিন্তু প্রতিনিয়ত যেহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মিষ্টি জলের পরিমাণ কমছে তাতে আগামিদিনে কৃষিতে জলসংকট বেড়েই যাবে। এই ভূগর্ভস্থ জমি অপরদিকে লবনাক্ততা বেড়ে চলেছে তাই এই “নবউদ্ভূত জলসংকট”- জল ও কৃষি প্রাণী বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। তিনদিনের আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল-

  • ভারতবর্ষের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ করে “সুন্দরবন” এলাকার জলের উৎস ও ব্যবহার।
  • ‘সুন্দরবনের জলসংকট’- এর কারণ ও তার প্রতিকার বা সমাধান সূত্র।
  • কৃষি ও প্রাণীপালনে কিভাবে জলের সংকট মেটানো যাবে।

এগুলোর সঙ্গে ছিল- প্রাকৃতিক পরিবেশের দিনদিন যেভাবে পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়ন সুন্দরবনের জৈব প্রকৃতির ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলেছে, তা থেকে বেরোনোর উপায় খোঁজার জন্য এই সম্মেলন।

বিশেষ সাক্ষাৎকারে পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী পালন ও উৎপাদন বিভাগের অধ্যাপক ডা. শান্তনু বেরা জানান-” দীর্ঘদিন প্রায় ১৫-১৮ বছর ‘সুন্দরবনের’ প্রত্যন্ত গ্রামে ও গ্রামীণ মানুষদের সাথে কাজ করে যে অভিজ্ঞতার কথা জানান তা “সংবাদ প্রভাকর টাইমস” কে না জানালে আমাদের এই সুন্দরবনের জনজীবন ও প্রাণীপালন ও কৃষির সম্বন্ধে অনেক কথা অজানা থেকে যাবে।

ডা. বেরার কথায়- “আগামী দিনে কৃষির জলসংকট যেভাবে বাড়ছে-তার ওপর এখানকার গ্রামীণ মানুষের প্রানীপালনে যে হারে আগ্রহ বাড়ছে যার পুরোভাগে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান প্রকল্প ফলে প্রাণীপালনে ও জলের প্রয়োজন বাড়ছে কিন্তু জলস্তর নিম্নমুখী লবনাক্তভাব বাড়ছে- মিষ্টি জলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে- তাই সব কিছু বাঁচাতে গেলে কি করতে হবে এই নিয়ে আলোচনা হয়। এই জলসংকট কাটাতে গেলে জলসংরক্ষণ করতে হবে। পুকুরে “অ্যাজোলা” চাষ করতে হবে যা জলের বাষ্পীভবন কমাতে সাহায্য করবে অপর দিকে ‘অ্যাজোলা’ প্রাণী খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে।ভূগর্ভস্থ জলকে ‘রিচার্জ’ -পুনঃজীবিত করতে হবে যা একটি নতুন পদ্ধতি- বড় বড় পাইপ লাইনের মাধ্যমে বৃষ্টির জলকে ভূগর্গস্থ করা।”

সুন্দরবনবনের মূল সমস্যা

বৃষ্টির জমা জল সব সমুদ্রে চলে যায়, এবার তা ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। মিষ্টি জল কম লাগে এমন ধরনের চাষাবাদ করতে হবে। কমসময়ের মধ্যে যে সকল ধান বা শস্য হয় তার চাষ করতে হবে। প্রাণীপালন বিশেষজ্ঞ হিসেবে এই আলোচনায় উপস্থিত থাকতে পেরে ডা. বেরা জানান- “একাধারে যেমন সমস্যাগুলো সম্বন্ধে সবাইকে জানানো সেই সঙ্গে তার সমাধানেরও উপায় বেরিয়ে আসল, এবার তাই গ্রামীণ মানুষকে জল অপচয় থেকে বিরত থাকার জন্য সচেতন করতে আমাদের আরও এগিয়ে আসতে হবে।”

প্রাণী বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ডা. শান্তনু বেরা। তিনি জানান- “সুন্দরবনের মানুষজন সংক্রামিত জল প্রাণীদের খেতে দেওয়ার ফলে তাদের রোগজীবাণুর সংক্রমণ বেশি হয়-সঠিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। অপরিষ্কার থাকার কারণে বহিঃপরজীব ঘটিত রোগ দিন দিন বেড়ে চলেছে।

কৃষিতে জলের অভাবের সঙ্গে সঙ্গে-প্রাণীদের ও মিষ্টিজলের যোগান কমে যাচ্ছে।তাই আশু সমস্যার সমাধান খোঁজার উদ্দেশ্য নিয়ে এই সম্মেলন। এই সম্মেলনে প্রায় ১৫০জন প্রতিনিধি যোগদান করেন।ইংল্যান্ড থেকে ৫জন, ইথিওপিয়া থেকে একজন, পুনে থেকে ৫জন, বাকি কিছু ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক, গবেষক, অধ্যাপক এবং চাষি, খামারি বন্ধুরা উপ্সথিত ছিলেন।

সব দিক বিবেচনা করে একজন প্রাণী বিজ্ঞানী হিসেবে বলি-

আগামীতে আসছে দিন।

জলসংরক্ষণে মন দিন।।

জল যদি না থাকে পড়ে-

কি করে “সোনার ধান” তুলবে ঘরে।।

Published on: জানু ১৩, ২০১৯ @ ১৫:৪৬


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

84 + = 91