“চোরগ্রাম” আজ হয়ে উঠেছে “ভালোগ্রাম”-এ যেন সত্যিই এক অন্য কাহিনি

দেশ রাজ্য
শেয়ার করুন

সংবাদপদাতা-বাপ্পা মণ্ডল       ছবিঃ রামপ্রসাদ সাউ

Published on: ডিসে ২০, ২০১৭ @ ২১:৫৬

এসপিটি নিউজ, ঝাড়গ্রাম, ২০ ডিসেম্বরঃ এক রাশ ‘ঘৃণা’, ‘অবজ্ঞা’, ‘বঞ্চনা’, ‘অত্যাচার’ আর ‘অপবাদ’- এগুলি ছিল ওদের একমাত্র প্রাপ্তি।’সহানুভূতি’, ‘মানবিকতা’, ‘ভালবাসা’ কি -তা ছিল ওদের কাছে একেবারে অজানা-অচেনা।দিনের আলো ফুটলেই পিঁপড়ের ডিম ভাঙা আর জঙ্গলে পাতা কুড়োনো আর অন্ধকার নামলেই নেশার ঘোরেই বুঁদ হয়ে থাকাটা ছিল ডালকাটি গ্রামের রোজকার ছবি। ছয় নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে অবস্থিত শবরদের এই গ্রামে তখন চুরি ছিল প্রধান জীবিকা।আশপাশের কোনও গ্রামে চুরি হলেই পুলিশ এসে এখানে তল্লাশি করত।নাম হয়ে গেছিল “চোরগ্রাম”। কিন্তু ছবিটা বদলে গেল রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে।বর্তমান সরকারের নজর পড়তেই নিজেদের বদলে ফেলতে শুরু করল শবররা।একদা “চোরগ্রাম” আজ হয়ে উঠল “ভালোগ্রাম।এ কাহিনি গল্পকেও হার মানাবে।

সংবাদ প্রভাকর টাইমস-এর প্রতিনিধি বাপ্পা মণ্ডল গেছিলেন সেই গ্রামে। ঘুরে দেখেছেন সেই গ্রাম। কথাও বলেছেন গ্রামের মানুষদের সঙ্গে।তাঁর চোখে অনেক কিছুই উঠে এসেছে। এখনও অনেক কিছু বাকি আছে। তবে, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খেলাধুলো সবেতেই আজ এই গ্রামের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ জানান দিচ্ছে-পিছিয়ে নয় সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে তারা। একদিন যাদের অন্ধকারে ঢেকে রেখে “চোর” বানানো হয়েছিল সেই শবররা আজ নয়া ইতিহাস গড়তে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে।সেকথাই বলছিলেন ৭০ বছর বয়সী নরেন শবর।

প্রবীণ এই গ্রামবাসী বলছিলেন তাদের পুরনো দিনের কথা। কি আর বলব-একটা সময় ছিল যখন আমাদের তো কেউ মানুষ বলেই মনে করত না। জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারদের মতো দেখত। সরকারি পরিষেবা তো অনেক দূরের কথা সামান্য খাবারটুকু পর্যন্ত জুটত না। বাধ্য হয়ে আমাদের তখন পেটের কাবার যোগাড়ের জন্য চুরির পথ বেছে নিতে হয়েছিল। সেই সময় কাছেপিঠে কোথাও চুরি হলেই পুলিশ হানা দিত আমাদের এই গ্রামে। লেখাপড়া কি জিনিষ কেউ তা জানত না। জানার চেষ্টাও আমাদের ছিল না। কি করে করব বলুন তো? যেখানে পেটের খাবার জোটে না সেখানে কিভাবে লেখাপড়ার কথা ভাবব? পেটে খাবার নেই, মাথার উপর ছাদ নেই। বাঁশের কঞ্চি দিতে ঘেরা আর মাথার উপর ত্রিপল দেওয়া কুঠরির নীচেই কোনওরকমে মাথা গুঁজে পড়ে থাকতে হত, বলছিলেন সত্তোরোর্দ্ধ নরেন শবর।

কিছুটা থেমে তিনি বলতে থাকেন, আজ রাজ্যের বর্তমান সরকার আমাদের কথা ভাবছে। তারা আমাদের ২ টাকা কিলো দরে চাল দিচ্ছে। গ্রামের ১৭৪টি পরিবারের বেশিরভাগকেই ঘর বানিয়ে দিয়েছে। আমাদের কাজ দিচ্ছে। আমরা আজ পয়সার মুখ দেখছি। গ্রামের ছোট ছেলে-মেয়েরা আজ স্কুলে যেতে শুরু করেছে।স্কুলে গিয়ে তারা আজ কবার পাচ্ছে। স্কুলের মেয়েরা বিনা পসায় পড়াশূনোর সুযোগ পাচ্ছে সঙ্গে টাকাও পাচ্ছে। এখন তাই আমরা চুরির পথ ছেড়ে দিয়েছি।সরকার যদি আমাদের জন্য কিছু করে তাহলে আমরা কেন ঐ পথে যাব বলতে পারেন? আমরাও তো মানুষ। আমাদেরও তো বাঁচার অধিকার আছে।আগের সরকার সেটা কি কোনওদিন ভেবেছে?

একই কথা শোনা গেল গ্রামের আর এক বাসিন্দা ৮০ বছরের বৃদ্ধা শেফালি শবরের মুখেও। তিনিও জানালেন, আজ এই গ্রামটিকে বদলে যেতে দেখে খুব ভাল লাগে। কি ছিল আর কি হচ্ছে। ছিলাম আমরা অন্ধকারে। কেউ আমাদের কথা ভাবতও না। শবর মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে তা আমরা কোনওদিন ভাবতেই পারতাম না। অথচ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সেটাও নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে, এটাও কি কম? আজ তো আমরা গ্রামের মহিলারা ১০০ দিনের কজের সুযোগ পাচ্ছে। আমি এই বয়সেও কাজ করছি। টাকা রোজগার করছি। এটা আমাদের কষ্টের রোজগারের পয়সা, এটাও কি কম আনন্দের!এ সব কিছুই হয়েছে রাজ্যে নতুন সরকার আসার পর।এখন আমরা ভাল হয়ে গেছি। সবাই পড়ছে, খেলছে, কাজ করছে।

ঠিকই বলেছেন ভরেন শবর, শেফালি শবররা। সত্যি এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন হয়েছে এই শবর গ্রামের। প্রখ্যাত সাহিত্যক মহাশ্বেতাদেবী এই শবরদের জন্য শেষদিন পর্যন্ত লড়ে গেছেন।মৃত্যুর আগে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন-“জঙ্গলমহলের এই মানুষগুলিকে তুমি দেখো। আমার বিশ্বাস, তুমিই পারবে ওদের মুখে হাসি ফোটাতে।” আজ তিনি বেঁচে নেই। কিন্তু, তাঁর সেই অনুরোধকে মাথায় নিয়ে আজ মুখ্যমন্ত্রী পিছিয়ে পড়া এই মানুষগুলির উন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য করে চলেছেন।

আজ এই গ্রামের ১৭৪টি পরিবারের বেশিরভাগেরই ঘর হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা আর গীতাঞ্জলি আবাসের প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছে তারা।কন্যাশ্রী প্রকল্পে এখানকার লোধা-শবর পরিবারগুলোর মেয়েদের পড়াশুনা করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।এর পরেও অনেক কিছুই বাকি থেকে যাচ্ছে। নির্মল বাংলাতেও এই গ্রাম এখনও পিছিয়ে। আর সেটা পূরণের লক্ষেই প্রশাসন স্তরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মেনেই ডালকাটি গ্রামে সমস্ত সরকারি প্রকল্পের উপযোগিতা তুলে ধরতে সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে। সবাইকে অবাক করেই মদ ও চুরিতে আসক্ত মানুষগুলি আজ সব কিছুকে দুরে সরিয়ে সরকারি প্রকল্পগুলির সহায়তা নিয়ে নিজেদের উন্নত করে তোলার চেষ্টা শুরু করছে।যা সত্যিই অভূতপূর্ব। পাশাপাশি এখনও যা-যা পায়নি তা বুঝে নিতে প্রশ্ন তুলে ধরেছে ডি.এম, বিডিওর কাছে। যেখানে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে শবর পরিবারগুলিকে নিয়ে এক বন ভোজনের অভিনব উদ্যোগ।

Published on: ডিসে ২০, ২০১৭ @ ২১:৫৬


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

66 − 58 =