স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৮তম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে তিনিটি পর্যায়ে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবে সংবাদ প্রভাকর টাইমস নিউজ পোর্টাল–এ। উদ্বোধন পত্রিকার ৮৩তম বর্ষের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণে লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল। লিখেছেন স্বামী চৈতন্যানন্দ, যিনি উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্বভার সামলেছেন।সংবাদ প্রভাকর টাইমস তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ এমন একটি লেখা দেওয়ার জন্য।আজ তার প্রথম পর্ব।
Published on: জানু ১২, ২০২১ @ ১০:২২
লেখক-স্বামী চৈতন্যানন্দ
ভগবান যীশু এই মর্তধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন মানুষের দুঃখকষ্ট দূর করতে।ঈশ্বর তাঁর স্কন্ধে চাপিয়ে দিয়েছিলেন মানুষের দুঃখকষ্টের ভার। ঈশ্বরের আদেশ পালন করতে তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছিল মৃত্যুর কাঠগড়ায়। চাবুকের কশাঘাতে সমস্ত শরীর রক্তাক্ত। সেই ক্ষতবিক্ষত শরীরের উপর পাষণ্ড সৈনিকরা বিদ্রুপ করে তাঁর গায়ে থুথু দিয়েছে।এ করেও তাদের খেদ মেটেনি। কাঁটার মুকুট পরিয়ে তাঁকে দিয়ে মৃত্যুক্রুশটি পর্যন্ত বহন করতে বাধ্য করেছে।তাঁকে নির্মমভাবে ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়েছিল। ক্রুশের উপর হাতে পায়ে পেরেক ঠুকে ঠুকে তাঁকে মারা হয়েছিল। সে কি নিদারুণ যন্ত্রণা। সেই তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও তাঁর হৃদয় করুণার্দ্র হয়েছিল ঐ হতভাগ্য অবুঝ মানুষগুলোর জন্য। ঈশ্বরের কাছে তিনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেনঃ ‘পিতা, এদের ক্ষমা কর। এরা কি করছে জানে না।’ দুই দস্যুর সঙ্গে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন তাঁর কাছে কাতর প্রার্থনা করলঃ ‘প্রভু, আপনি যখন আপনার রাজ্যে গিয়ে প্রবেশ করবেন, তখন আমাকে স্মরণ রাখবেন।’ যীশু নিজের মৃত্যুযন্ত্রণা ভুলে গিয়ে তাকে অভয় দিয়ে বললেনঃ ‘আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আজকেই তুমি আমার সঙ্গে স্বর্গে যাবে।’ তিনি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন মানুষকে মুক্তি দিতে, চিরশান্তির পথের সন্ধান দিতে। তিনি নিজেকে আহুতি দিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণের জন্য।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমরা আর একজনকে দেখি মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিতে- তিনি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। প্রথম জীবনে তিনি চেয়েছিলেন নিজের মুক্তি। অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে কাশীপুরে একদিন তিনি (তখন নরেন্দ্রনাথ) চাইলেন মুক্তি- সমাধিতে শুকদেবের মতো লীন হয়ে থাকতে। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেব মুক্তি দিলেন না। তিনি তিরস্কার করে বলেছিলেনঃ ‘ছিঃ ছিঃ, তুই এতবড় আধার, তোর মুখে এই কথা! আমি ভেবেছিলাম, কোথায় তুই একটা বিশাল বটগাছের মতো হবি, তোর ছায়ায় হাজার হাজার লোক আশ্রয় পাবে, তা না হয়ে তুই কিনা শুধু নিজের মুক্তি চাস!’ তবে শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁকে একেবারে নিরাশ করেননি। তিনি তাঁকে নির্বিকল্প সমাধির আনন্দের স্বাদ পাইয়ে দিয়ে বলেছিলেনঃ ‘এখন তোকে কাজ করতে হবে। যখন আমার কাজ শেষ হবে তখন আবার চাবি খুলব।’ শ্রীরামকৃষ্ণদেব চাপিয়ে দিলেন নরেন্দ্রনাথের কাঁধে দুঃখক্লিষ্ট মানুষের ভার। নরেন্দ্রনাথ ভুলে গেলেন নিজের মুক্তির কথা। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নবীন বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বুঝলেন নিজের মুক্তির চেষ্টা- স্বার্থপরতা। অন্যের মুক্তির জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন তিনি। মানুষের দুঃখকষ্টের ভার লাঘব করে তাকে পরমানন্দের মন্ধান দেওয়াই তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে দাঁড়াল। এই ব্রত উদযাপনের জন্য তিনি নরক-যন্ত্রণা ভোগ করেও হাজারো বার জন্মগ্রহণ করতে প্রস্তুত। পরবর্তী কালে তিনি বলেছিলেনঃ ‘…এই জগতের দুঃখ দূর করতে আমায় যদি হাজারো জন্ম নিতে হয়, তাও নেবো। তাতে যদি কারও এতটুকু দুঃখ দূর হয় তো ক’রব।’
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দেওয়া মানুষের দুঃখ-যাতনার ক্রুশটি আজীবন তিনি বহন করেছিলেন। তাঁর জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব তিনি কিভাবে মানুষের দুঃখকষ্ট দূর করতে গিয়ে নিজেকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর মৃত্যু ভগবান যীশুর মতো কাঠের তৈরি ক্রুশের উপর পেরেক ঠুকে হয়নি; তাঁর মৃত্যু হয়েছিল মানবজাতির দুঃখকষ্টের ক্রুশে। সমগ্র মানবের দুঃখ-যাতনার তুষানল তাঁকে দগ্ধ করে হত্যা করেছিল। তিনি স্বেচ্ছায় নিজেকে আহুতি দিয়েছিলেন এই দুঃখ-যাতনার তুষানলে।
তাঁর জীবনের শুরুতেই দেখা যায় পরদুঃখ-কাতরতার বীজটি অঙ্কুরিত হতে। কোন ভিখারি বা সাধু বালক নরেন্দ্রনাথের কাছে একখানি কাপড় চাইলে তিনি দ্বিধামাত্র না করে, তাঁর পরনের নতুন কাপড়খানি খুলে দিয়ে সাহায্য করতেন। অসুস্থ রুগ্ন মানুষকে সেবা করার দরদী মনের পরিচয়ও ছোটবেলাকার ঘটনার মধ্যে পাওয়া যায়। কুড়ি-পঁচিশজন সমবয়স্কদের সঙ্গে গড়ের মাঠে কেল্লা দেখতে যাওয়ার সময় তাঁদের মধ্যে একজন অসুস্থ হয়ে পড়লে, সবাই যখন অসুস্থ বালকের কিছু হয়নি ভেবে হাসি-ঠাট্টা করতে করতে এগিয়ে চলেছে, তখন নরেন্দ্রনাথের মনে ঐ বালকের জন্য সমবেদনা দেখা যায়। তিনি অসুস্থ বালকের কাছে ছুটে এসে গায়ে হাত দিয়ে দেখেন, প্রচণ্ড জ্বর। তিনি তাকে গাড়ি করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসেন। এমনকি মানুষের কষ্ট লাঘব করতে যে সেবার প্রয়োজন তা করতে বিপদের সময়ও তাঁকে বিচলিত দেখা যায়নি। নির্ভীক হয়ে, বিপদকে উপেক্ষা করে তিনি সেবা করেছেন, তাও আমরা দেখি তাঁর ছোটবেলাকার ঘটনার মধ্যে। নরেন্দ্রনাথ ট্রাপিজ খাটাতে যখন চেষ্টা করছেন এক সাহেবের সাহায্যে তখন দড়ি ছিঁড়ে সাহেবের কপালে বিষম আঘাত লাগে। আঘাতে সাহেব অজ্ঞান হয়ে যান এবং ক্ষতস্থান থেকে রক্তস্রোত বইতে থাকে।একে তো সাহেব, তার উপর এই অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ও রক্তস্রোত! দেখে সঙ্গীরা ভয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ পালিয়ে গেলেন না। কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে সাহেবের সেবা-শুশ্রুষা করতে লাগলেন। নিজের পরনের কাপড় ছিঁড়ে ক্ষতস্থানে জড়িয়ে দিয়ে এবং চোখে-মুখে ঠাণ্ডা জল ছিটিয়ে দিয়ে চেতনা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন। এইভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা নিজের হাতে করে তারপর ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। ডাক্তারের পরামর্শে এক সপ্তাহ ধরে তাঁকে সেবা-শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তোলেন। এবং পাড়ার লোকদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে পাথেয় হিসেবে কিছু দিয়ে তাঁকে বিদায় করেন। ভবিষ্যতে যিনি সারা বিশ্বের দুঃখ-যাতনার ভার নিজের কাঁধে তুলে নেবেন তারই উন্মেষ বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে দেখা যায়। ক্রমশঃ
Published on: জানু ১২, ২০২১ @ ১০:২২