লেখক– তারকব্রহ্ম দাস ব্রহ্মচারী
Published on: জানু ১০, ২০১৯ @ ১৯:৪১
এসপিটি বিশেষ প্রতিবেদনঃ ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতি ও সাহিত্যে গঙ্গাসাগর সঙ্গম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মহাতীর্থ। অতি প্রাচীন কাল হতেই অধ্যাত্ম পথের সাধক, মুনিঋষি, সাধুসন্তগণ গঙ্গার তটভূমিতে আশ্রয় নিয়ে তারা তাদের পরম প্রাপ্তি লাভ করেছেন। অগণিত মঠ মন্দির, দেবালয়, তীর্থক্ষেত্র গড়ে উঠেছে গঙ্গার উভয় তীরে। গঙ্গাতীরে যাগ-যজ্ঞ, শাস্ত্রপাঠ, দান, তপস্যা, জপ, শ্রাদ্ধকৃত্য, দেবতা পূজন যা কিছু অনুষ্ঠিত হয় তা কোটিগুণ ফল প্রদান করে। তাই গঙ্গার পবিত্রতায় আকৃষ্ট হয়ে পমাকর্ষণে সাধুসন্তগণ আশ্রয় গ্রহণ করেন গঙ্গার পুণ্য তটভূমিতে।
মহর্ষি কপিল দেবের সাধনার পাদপীঠ গঙ্গাসাগর সঙ্গম। এই সুপ্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্র সাধুসন্ন্যাসী ও ধর্মপ্রাণ মানুষের এক মহান তীর্থস্থান। বঙ্গদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত নদী ও সমুদ্র বিধৌত নিম্নভূমিই গঙ্গাসাগর সঙ্গম নামে পরিচিত। এখানেই ধ্যানরত কপিলদেবের হুঙ্কারেই সগর রাজের ষাট হাজার সন্তান ভস্মীভূত হয়েছিল। সগর সন্তানগণের সন্ধানে আগত অংশুমানকে কপিলমুনি বললেন- যদি পুণ্যতোয়া গঙ্গাদেবী এসে এদের অভিসিক্ত করেন তবেই এরা মুক্ত হতে পারবেন। অতঃপর সগররাজ, অংশুমান, দিলীপ বহু তপস্যা করেও উর্দ্ধলোক হতে গঙ্গাকে আনয়ন করতে সক্ষম হন নাই। অবশেষে রাজা ভগীরথ পিতৃপুরুষদের উদ্ধারের জন্য কঠোর তপস্যা করে গঙ্গাকে আনয়ন করে কপিলদেবের আশ্রমের নিকটে সাগর তটে নিয়ে আসলে মুনিবর গঙ্গাদেবীকে স্বাগত জানিয়ে সগর সন্তানগণের দুর্গতির কথা নিবেদন করেন। ত্রিলোকপাবনী মাতা গঙ্গাদেবী তখন পবিত্র সলিল সিঞ্চনে ভস্মীভূত সগর সন্তানগণকে দিব্য গতি প্রদান করেন।পবিত্র গঙ্গাসলিলের স্পর্শ পেয়ে সগর সন্তাঙ্গণ মুক্ত হলেন। এই সেই শুভ্র বালুকাযুক্ত সুবিস্তৃত বেলাভূমি, নিকটে সবুজ বনানী, সীমাহীন সৌন্দর্য্য সম্ভারে সজ্জিত ভূমিই গঙ্গাসাগর সঙ্গম।
গঙ্গাসাগর সঙ্গম মহাতীর্থ একবার বা একদিনের জন্য নয়, গঙ্গাসাগর সঙ্গম নিত্য মহাতীর্থ। কেননা গঙ্গাসাগর মহাতীর্থের মাহাত্ম্য অপরিসীম, অনির্বচনীয় এবং অপরিমেয়। স্কন্দ পুরাণে আছে- মানব সকল তীর্থ দর্শন, দান, তপস্যা, দেবপূজা, যজ্ঞাদিতে যে ফল লাভ করেন, তা একমাত্র গঙ্গাসাগর সঙ্গমে স্নানে লাভ হয়- “লভতে পুরুষঃ সর্ব্বং স্নাত্বা সাগর সঙ্গমে।” পদ্ম পুরাণে আছে- কলিযুগে একমাত্র গঙ্গাকেই আশ্রয় করা কর্তব্য – “কলৌ গঙ্গা সমাশ্রয়েৎ।” যারা সশরীরে গঙ্গা স্নানে যেতে অসমর্থ তারাও যদি -“গঙ্গা গঙ্গেতি যো ব্রুয়াৎ যোজনাং শতৈরপি। মুচ্যন্তে সর্ব্বপাপেভ্য বিষ্ণুলোকং স গচ্ছতি।” অর্থাৎ কেহ যদি ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে শত যোজন (আটশত মাইল) দূরে বসে – “গঙ্গা গঙ্গা” বলে ডাকেন সকল প্রকার পাপ হতে মুক্ত হয়ে তিনিও ভগবান বিষ্ণুর লোকে গমন করেন।
গঙ্গাসাগর মেলার প্রধান আকর্ষণ শ্রীকপিল দেবের মন্দির। শ্রীমন্দিরে কপিলদেব পদ্মাসনে যোগরূঢ় অবস্থায় উপবিষ্ট।তাঁর বাম হাতে কমন্ডুল, ডান হাতে জপমালা, শিরোদেশে পঞ্চনাগ ছত্রবৎ অবস্থিত। শ্রীকপিল দেবের দক্ষিণে শ্রীগঙ্গাদেবীর বিগ্রহ। ইনি চতুর্ভূজা এবং মকর বাহন। শ্রীহস্ত সমূহে শঙ্খ, পদ্ম, অমৃতকুম্ভ ও বরাভয়। সম্মুখে মহাতাপস ভগীরথ।কপিলদেবের বিগ্রহের বামপার্শ্বে সগর রাজ ভক্তি বিনম্র চিত্তে করজোড়ে অবস্থান রত। এই গঙ্গাসাগর সঙ্গমে মকর সংক্রান্তি দিবসে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী মহাস্নান করে থাকেন। গঙ্গাস্নান, গঙ্গাপূজা, গঙ্গায় তর্পনাদি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তির সহিত ঐ পুণ্য দিবসে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। গঙ্গাসাগর সঙ্গমে মকর স্নানের বিশেষ মন্ত্র, যথা-
“ত্বং দেব সরিতাং নাথ ত্বং দেবী সরিতাম্বরে।
উভয়োঃ সঙ্গমে স্নাত্বা মুঞ্চামি দুরিতানি বৈ।।”
এই মন্ত্র উচ্চারণ পূর্ব্বক স্নান করা অবশ্য কর্তব্য। স্নানান্তে দানাদি কার্য বিধেয়।
জগৎ জীবের উদ্ধারের জন্য ত্রিলোক পাবনী গঙ্গাদেবীর এই জগতে আগমন। তাই আমরা এই মহাতীর্থ গঙ্গাসাগর সঙ্গমে মকর সংক্রমের স্নান মহোৎসবের দিনে ত্রিলোক জননী গঙ্গাদেবীর চরণ সমীপে প্রার্থণা করি- “হে মাতঃ গঙ্গে! আপনি এই ভারত ভূমিতে শুভাগমন করে যেমন সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলায় প্রাকৃতিক সম্পদে দেবী বসুন্ধরাকে সমৃদ্ধ করেছেন, ভস্মীভূত সগর সন্তান গণের পরম কল্যাণ বিধান করেছেন, তেমনি – “হে শান্তি সম্পাদন কারিণী! হে প্রণতার্তিহারিণী জগন্মাতঃ! দুঃখ-ক্লেশে লাঞ্ছিত, ত্রিতাপে দগ্ধীভূত, বেদনায় আর্তনাদ গ্রস্ত জীব-জগতের প্রতি আপনার তরঙ্গ থেকে আগত স্নিগ্ধ সমীরণ প্রবাহিত করে তাদের ত্রিতাপে তাপিত হৃদয়ে সুশীতল শান্তির স্পর্শে পরমানন্দের সঞ্চার পূর্বক পরম কল্যাণ বিধান করুন।
Published on: জানু ১০, ২০১৯ @ ১৯:৪১