কেন এমনটা হয়ে চলেছে ভেবে দেখার সময় এসেছে

উত্তর সম্পাদকীয় দেশ
শেয়ার করুন

অনিরুদ্ধ পাল

Published on: ডিসে ১৮, ২০১৮ @ ১৭:১৯

সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত আমাদের চারপাশে যা ঘটে চলেছে তা কি লক্ষ্য করে দেখেছেন? সেভাবে দেখার মতো করে খুব কম মানুষই তা দেখে থাকেন। আর তারাই এখন সমাজের কাছে অবহেলিত, ঘৃণার পাত্র, আরও কত কী। এমনটা কী তবে চলতে থাকবে? আমরা সবাই কি তবে এ নিয়ে এতটুকু ভাবব না? এই প্রশ্নগুলি কিন্তু এখন উঠছে, বলা ভাল উঠতে শুরু করেছে।

ভাল করে একবার মনে করুন যে কথাগুলো আমি এই প্রতিবেদনে লিখছি যা আপনারা পড়ছেন তা আপনারা চোখের সামনে দেখেন কিংবা শুনে থাকেন। কখনও সেগুলি নানাভাবে খবরের আকারেও সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা নিউজ চ্যানেলের পর্দায় ভেসে ওঠে। কোনও সাংবাদিক আগে দেখিয়ে কৃতিত্ত্ব নেন- সংবাদ মাধ্যমের ভাষায় বলে থাকেন-“এক্সক্লুসিভ” কিংবা “ব্রেকিং নিউজ”।

আরও পরিষ্কার করে বলি- সেদিন আমার মেয়ের স্কুলের অ্যনুয়াল ফাংশন ছিল। অভিভাবক হিসেবে অন্যাদের মতো আমিও সেখানে হাজির ছিলাম। অনুষ্ঠান ভালই হচ্ছিল। আইসিএসসি বোর্ডের এই স্কুলটি এই বছর আইসিএসসি ও আইএসসি দু’টিতেই অসাধরণ পারফরম্যান্স করেছে।তিনজন ছাত্র মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মানিতও হয়েছে। এসব খুব ভাল কথা। কিন্তু যে বিষয়টা শুধু আমাকে নয় আমার ছোট্ট মেয়েটি ও তাঁর বন্ধুকেও অবাক করে দিয়েছে তা হল পিছনে বসে থাকা কয়েকজন অভিভাবিকার কথপোকথন। ভাবতে অবাক লাগে যে মায়েদের মুখেই যদি এমন অশোভনীয় কথা শোনা যায় তাহলে তাদের সন্তানরা কি শিখবে?

স্কুল কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি ইংরাজি মাধ্যমের স্কুলের কর্তা-ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁদের স্বাগত জানানোর পর স্থানীয় এক বাংলা মাধ্যমের একটি হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষককেও সম্মানিত করা হয়। আর তখনই পিছনে বসা বেশ কয়েকজন মায়েরা ৯১ বছরের ওই প্রবীণ শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে টিপ্পনি কাটতে থাকেন। “বুড়ো” বলে সেই শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে তারা বলতে থাকেন-দ্যাখ, বুড়োটা মঞ্চে উঠে নিজেই বসে পড়ল। বুড়োটা আবার নিজেই মাইক্রোফোন নিয়ে বলতে শুরু করল। কথাগুলি আমার মেয়ে ও তার বন্ধু শুধু নয় সেখানে থাকা স্কুলের আরও বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীও তা শুনে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল।

আমার প্রশ্ন, যেখানে মায়েরা একজন প্রবীণ শিক্ষককে সম্মান জানাতে জানে না তারা তাদের সন্তানদের কাছ থেকে কি আশা করে? আর তাই বোধ হয় সেই প্রবীণ শিক্ষক মাইক্রোফোন কাছে টেনে নিয়ে দু’চার কথা বলেন। তাঁর বক্তব্যের মূল ফোকাস ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করা।তিনি বলে ওঠেন-“তোমাদের অনেকে এ হতে বলবে ও হতে বলবে। আমি বলব সবার আগে তোমরা মানুষ হও।মানুষের মতো মানুষ হও। তিনি এও বুঝিয়ে দিয়েছেন- মানুষ হওয়া মানে একজনের বিপদে পাশে থাকা। তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। তাঁকে নিয়ে মজা করা নয়। তাঁর খুঁত ধরা নয়। তাঁকে দূর থেকে দেখে তামাশা দেখা নয়। মানুষ সেই হয় যে কিনা অন্যের পাশে থাকে। অপরকে সাহায্য করে। সেই প্রবীণ শিক্ষক যথার্থই বলেছেন। তবে সবার আগে বাবা-মা-কে ঠিক হতে হবে তা না হলে ছেলে-মেয়ে যত ভাল স্কুলেই পড়ুক না কেন যত ভাল রেজান্ট করুক না কেন প্রকৃত মানুষ কিন্তু তারা হতে পারবে না।আজ যেটার বড়ই অভাব দেখা দিয়েছে। সময় এসেছে আমাদের এই বিষয়টা ভেবে দেখার।

শুধু স্কুলে নয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলেও এই একই সমস্যা চলছে। সবাই কেরিয়ারিস্ট হওয়ার জন্য ছুটে চলেছে। কেউ মানুষ হওয়ার কথা ভাবছে না। আর সেটা ভাবিয়েছে কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও। পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক পূর্ণেন্দু বিশ্বাস সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে ছাত্র-ছাত্রীদের ঠিক এই কথাটাই মনে করিয়ে দিয়েছে। তোমরা আগে মানুষ হও। চাকরি করো। অনেক বড় হও। কিন্তু সবার আগে মানুষ হও। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের আরো বলেন-যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে তাকে নিজের পরিবার মনে করে কাজ করবে। তার অপমান মানে আমার অপমান। মানে আমার মায়ের অপমান। এই বোধ যতক্ষন তোমাদের মধ্যে না জাগবে ততদিনে কিছুই হবে না। এই শিক্ষা আগে জরুরী।

তিনি একেবারেই ঠিক কথা বলেছেন। খুব দুর্ভগ্যের যে আজ আমাদের এইসব নিয়ে লেখালিখি করতে হচ্ছে। প্রবীণ শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলেও ছাত্র-ছাত্রীদের মানুষ হওয়ার পাঠ শেখাতে হচ্ছে। তাহলে বুঝতেই পারছেন কোন দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে আমাদের অতিক্রম করতে হচ্ছে।

এ এমন এক সমাজে আমরা বাস করছি যেখানে মদ খাওয়ার জন্য ফূর্তি করার জন্য লোকে কোটি কোটি খরচ করতে দ্বিধা করে না। এ এমন এক সমাজ যেখানে বিত্তবানরা নিজের সন্তানের বিয়ের অনুষ্ঠানকে শতাব্দীর সেরা বিয়ের অনুষ্ঠানের রূপ দেওয়ার জন্য কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করতেও কার্পন্য করে না। এ এমন এক সমাজ যেখানে বড় বড় ভাষণ দেওয়া নেতা-মন্ত্রীরা ক্ষমতার আতিশয্যে থেকে পকেট ভরাতে ভুল করে না। আবার এ এমন এক সমাজ যেখানে সামান্য এক ফোটা জলের জন্য মানুষকে হাহাকার করে মরতে হয়। আবার এ এমন এক সমাজ যেখানে কোনও সহৃদয় মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে অপরের প্রাণ বাঁচিয়ে মৃত্যুশয্যায় থেকে বাঁচার জন্য লড়াই চালাতে হয়, যেখানে চিকিৎসার ২০ লক্ষ্য টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয় তাঁর বাড়ির লোকজনকে। আবার এ এমন এক সমাজ যেখানে ভোটে জিতে আসা নেতা বদলে যান ভোটারদের বিপদের খোঁজ রাখেন না তাদের পাশেও থাকেন না। সত্যি এ আমাদের চরম দুর্ভাগ্য।ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু তা কতটুকু বলুন তো?

আমরা যদি কারো উপকারে না লাগতে পারি তাহলে কাউকে টিপ্পনি কাটা অরুচিকর মন্তব্য করার অধিকার কে দিয়েছে? কারো শান্তি বিঘ্নিত করা, কাউকে অসুবিধায় ফেলে দেওয়া, কারও সাফল্য নিয়ে সমালোচনা করা, হিংসা করা এসব বন্ধ হওয়া দরকার।না হলে সামনে এক বড় বিপদ অপেক্ষা করে আছে। এ বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা পেতেই হবে। এজন্য সকলকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। এসব ভেবেই বোধ হয় একদিন কিংবদন্তী গায়ক ভূপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন-“মানুষ মানুষের জন্য/ জীবন জীবনের জন্য/ একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না…!”

Published on: ডিসে ১৮, ২০১৮ @ ১৭:১৯

 

 

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

+ 39 = 49