সংবাদদাতা- সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Published on: ফেব্রু ১৪, ২০১৮ @ ২২:৫২
এসপিটি নিউজ,বারুইপুর, ১৪ ফেব্রুয়ারিঃ ওদের কেউ পড়ে স্কুলে কেউ বা কলেজে। ওদের অস্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিয়ে কিন্তু কোনও হেলদোল ছিল না ওদের বাবা-মায়েদের। মঙ্গলবারের পর এখন তারা হা-হুতাশ করছে। কিন্তু স্ররবনাশ যা হোওয়ার হয়ে গেছে তাদের গুণধর ছেলে-মেয়েদের। ওদের কেউ হাসপাতালে কেউ শ্রীঘরে।
বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার নাম করে বিকালবেলায় বাড়ি থেকে বের হয়েছিল।সেখানে বসেছিল মদের আসর।সন্ধ্যায় সেই বাড়ির শৌচালয়ে অচৈতন্য অবস্থায় পাওয়া গেল দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীর অচেতন দেহ। গ্রেফতার করা হল বাড়ির যুবক সহ তিনজনকে। যাদের মধ্যে একজন কলেজ ও একজন স্কুল ছাত্র। গ্রেফতার হওয়া তিনজনের বিরুদ্ধে গণধর্ষণ ও ছাত্রীকে খুনের চেষ্টার গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। ধর্ষিতা ছাত্রীর বিরুদ্ধেও পুলিশের কাছে এসেছে গুরুতর কিছু তথ্যও।
দ্বাদশ শ্রেণীর ১৭ বছরের এক ছাত্রীকে ঠান্ডা পানীয়র সাথে মাদক খাইয়ে গণধর্ষণ ও শারীরিক যৌন হেনস্থা করে খুনের চেষ্টার অভিযোগ উঠল তারই প্রেমিকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটে সোনারপুর থানার ২৬ নম্বর ওয়ার্ড নরেন্দ্রপুর রথতলা এলাকায় মঙ্গলবার বিকালে। প্রেমিকের বন্ধুর বাড়ির শৌচালয়ে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ছাত্রীকে।
তার পরিবারের লোকজন ও স্থানীয় বাসিন্দারা রাতেই তাকে নিয়ে যায় সুভাষগ্রাম হাসপাতালে। সেখান থেকে পিয়ারলেস বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ঘটনায় ছাত্রীর মা মৌসুমি চক্রবর্তী সোনারপুর থানায় বুধবার দুপুরে অভিযোগ দায়ের করে। সোনারপুর থানার পুলিশ রাতেই তিন অভিযুক্ত অর্ঘ্য দাস, তমজিত মিত্র ও উৎপল গায়েনকে আটক করেছি্ল।
বুধবার দুপুরের পর অভিযোগ দায়ের হলে তাদের তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনজনের বিরুদ্ধে ৪৭৬ডি, ৩০৭ ও নির্যাতনের মামলা রুজু করা হয়েছে। তিনজনকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ অভিযুক্ত উৎপলের দাদাকে আটক করে তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়েছিল। ছাত্রীর মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হয়েছে।
ঘটনা প্রসঙ্গে স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সোনারপুরের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড মানিকপুরের বাসিন্দা ১৭ বছরের মেয়ে স্থানীয় কোদালিয়ার একটি স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। পুলিশ জানিয়েছে, নরেন্দ্রপুর রথতলার বাসিন্দা বছর ৩০ এর বেশি উৎপল গায়েনের দোতলার বাড়ির একতলায় দুপুর ১২টার পর থেকে মদ্যপানের আসর বসেছিল। উৎপলের মা মমতা গায়েন, কাকা নিমাই গায়েন সবাই মঙ্গলবার সকাল ১১ টায় বাড়ি বিষ্ণুপুরের বলাখালিতে গিয়েছিল নিজেদের পুজার ব্যাপারে।
বাড়ি ফাঁকা থাকার সুযোগ নিয়ে উৎপল ডেকে নেয় হরিনাভির বাসিন্দা একাদশ শ্রেণীর ছাত্র তার বন্ধু তুয়া ওরফে তমজিত মিত্র। আসে ১৭ বছরের ছাত্রীর প্রেমিক রাজপুরের বাসিন্দা জার্নালিজম অনার্স-এর ছাত্র অর্ঘ্য দাসও।
এই প্রসঙ্গে উৎপলের মা জানায়, আমরা বাড়িতে ছিলাম না। ছেলের কাছ থেকে শুনি অর্ঘ্য দাস মঙ্গলবার দুপুর তিনটের সময় বাড়িতে তার প্রেমিকা ১৭ বছরের ছাত্রীকে নিয়ে আসে। আমরা মঙ্গলবার বিকাল পাঁচটার পর বাড়িতে ফিরে দেখি ওই ছাত্রী আমাদের ঘরের শৌচালয়ে বালতির উপর অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে ছিল। প্রচুর বমি করছিল। মদ খেয়েছিল সবাই।
এদিকে এই বিষয়ে ছাত্রীর দিদি চন্দ্রিমা চক্রবর্তী জানায়, “মঙ্গলবার সন্ধে সাতটায় আমরা কিছু লোকের কাছ থেকে খবর পাই আমার বোনকে উৎপলের বাড়িতে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আমরা যাই, গিয়ে দেখি শৌচালয়ে রক্ত পড়ে থাকতে। আমার বোনকে ঠান্ডা পানীয়র সাথে মাদক খাইয়ে গনধর্ষণ করে খুনের চেষ্টা করে অর্ঘ্য, তমজিত ও উৎপল। আমরা বোনকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”
চন্দ্রিমার আরও অভিযোগ, “আমার বোনের মোবাইল-সহ কানের জিনিস খোয়া গিয়েছে। বোন বাড়ি থেকে বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি বলে বেরিয়েছিল। তার পরে উৎপলের বাড়ি এসেছিল। পরনে জিনস আর টপ ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধেতে যখন উৎপলের বাড়ি থেকে বোনকে উদ্ধার করি নাইটি পরিহিত অবস্থায়। আমার মা-কে দিয়ে লিখিত মুচলেকা নেওয়া হয় যে মেয়েকে নিয়ে গেলাম।”
সোনারপুর থানার পুলিশ রাতেই নরেন্দ্রপুরের রথতলার উৎপলের বাড়ির ঘরের বিছানা থেকে লিমকা ঠাণ্ডা পানিয়, চানাচুরের প্যাকেট, সিগারেট ও একটা ওষুধের খালি প্যাকেট, চারটে মদ খাওয়ার গ্লাস উদ্ধার করেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, উৎপলের কাকা নিমাই গায়েন জানিয়েছে মঙ্গলবার সন্ধে পাঁচটায় যখন সে বাড়ি ফেরে তখন সে উৎপলকে দেখেনি। উৎপল সিগারেট আনতে গিয়েছিল। ঘরে প্রথমে শুয়ে ছিল অর্ঘ্য আর তমজিত। আমাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে তমজিত শৌচালয়ের সামনে চলে গিয়ে কিছু পাহারা দিতে থাকে। আমি তাকে সরিয়ে শৌচালয়ে ধাক্কা মারলে ওই ছাত্রীর আওয়াজ পাই। এর পর ওরা দুইজন পালাতে যায় কিন্তু আমরা ধরে ফেলি। ঘরে প্রায় ৩ বোতলের বেশি মদ খাওয়া হয়েছিল। উৎপলের দাদা দুপুর ১২ টার পর থেকে অর্ঘ্য, তমজিত আর উৎপলের সাথে থাকলেও দুপুর ৩ টে ১০-এ ওই ছাত্রী ঘরে এলে সে চলে গিয়েছিল।
পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে, উৎপলের বাড়িতে প্রায় মদ্যপানের আসর বসত। সেই মদ্যপানে অর্ঘ্য-তমজিত হাজির হত। ওই ছাত্রী তার প্রেমিক অর্ঘ্যর সাথে বাড়িতে এসেছিল দুপুর তিনটের পরে। প্রাথমিক মেডিক্যাল পরীক্ষায় ওই ছাত্রী যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত তা জানা গিয়েছে। তার জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে। কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।তদন্ত চলছে।
এই ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে অনেকগুলি প্রশ্নঃ
১)প্রথম, উৎপলের বাড়ির লোকজনের কাছেই।বাড়িতে তাদের গুণধর ছেলে মদের আসর বসায়, একথা পাড়ার লোকজন জানলেও তারা জানেন না এটা কিভাবে সম্ভব?
২) উৎপলের কাকার বক্তব্য অনুযায়ী-উৎপলের দাদা দুপুর ১২টা পর্যন্ত অর্ঘ্য ও ত্মোজিতের সঙ্গে থাকলেও পরে ঐ ছাত্রী ঘরে এলে সে নাকি বেরিয়ে যায়। এখন প্রশ্ন, তাদের ঘরে ভাইয়ের বন্ধুর এক বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে, কেন সে ঘরে প্রশ্রয় দিল? তাহলে কি এর আগেও ঐ ছাত্রী তাদের বাড়িতে আসত?
৩) ঘরে বাবা-মা-কাকারা ছিল না ঠিকই, কিন্তু দাদা তো ছিল। তাহলে কি এই ঘটনায় উৎওপলের দাদাও সব কিছু জানত?কেন সে ভাইকে ঘরের ভিতর মদ-সিগারেট-মেয়েছেলে নিয়ে ফূর্তি করার অনুমতি দিল?
৪) একটা একাদশ শ্রেণির ছাত্র তমোজিত ও অনার্সের ছাত্র অর্ঘ্য বকে যাচ্ছে। দুপুর বেলায় অন্য কোথাও এসে মদের আসর বসিয়ে মেয়েছেলে নিয়ে নিজেদের যৌন ইচ্ছে পূরণ করছে। এটা কি সত্যিই জানত না তাদের বাব-মা কিংবা বাড়ির লোকজনরা?
৫) সবশেষে, আসছে দ্বাদশ শ্রেণির ঐ ছাত্রীর বাড়ির লোকজনের ভূমিকার বিষয় একটা মেয়ে বাড়ি থেকে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার নাম করে মদের আসরে গিয়ে ছেলেদের সঙ্গে বপরোয়াভাবে মেলামেশা করছে, এটা সত্যিই তার বাবা-মা-দিদি জানতে পারেনি এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য?
৬)মেয়েটির দিদির কথানুযায়ী, বোন বাড়ি থেকে জিন্স আর টপ পড়ে বেড়িয়েছিল। আর তাকে উদ্ধার করা হল একটি নাইটি পড়া অবস্থায়। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, ওই নাইটি সে কোথায় পেল? সেটি কি উৎপলদের বাড়িতেই তাকে পড়তে দেওয়া হয়েছিল? আর তা যদি হয়, নাইটি আনল কে? মেয়েটি নিজে না কি তার সঙ্গীরা?
গোটা ঘটনায় কিন্তু অনেকগুলি বার্তা রয়েছে। সেটা খতিয়ে দেখার কাজ পুলিশ প্রশাসনের। তারাই তদন্ত করে আসল সত্য উদ্ঘাটন করুক, সেটাই চায় সকলে। এখন শুধুই প্রতীক্ষা।
Published on: ফেব্রু ১৪, ২০১৮ @ ২২:৫২