সেদিন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মাটি হাতে নিয়ে শপথ করানোর সময় আমাদের কি বলেছিলেন জানেন

এসপিটি এক্সক্লুসিভ দেশ বাংলাদেশ
শেয়ার করুন

আজ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ জাতির জনক শেখ মুজিব-এর ৯৯ তম জন্মদিবস। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আমরা বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহধন্য অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক, এমপি সংবাদ প্রভাকর টাইমস-এর কাছে তাঁর আদর্শ প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন। সেটাই আমরা তুলে ধরলাম পাঠকদের কাছে।জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক, এমপি

মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

Published on: মার্চ ১৭, ২০১৮ @ ০৯:২৬

১৯৬৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিতি। আমার সেই সুযোগ হয়েছে। সৌভাগ্যও হয়েছে। গাজীপুর থেকে গিয়েও আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেছি। তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কান ধরে টানতেন, চুল ধরে টানতেন, গাল ধরে টানতেন। তার যে ভালোবাসা ভোলার নয়।

আমার প্রথম স্মৃতিটা হচ্ছে যদি রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করি সেটা আজকের-  এই যে ইব্রাহিম ম্যানসান-এ একদিন আমরা ছাত্রলীগের সদস্যরা সিরাজদৌলাখান তখন মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন যদিও পরবর্তীকালে তিনি রাজনীতিতে থাকতে পারেননি। তিনি ভিন্ন অবস্থানে ছিলেন বা আছেন। কিন্তু তখন স্বাধীনতার পূর্বে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করার জন্য।বঙ্গবন্ধু তাঁর উপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেইসময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বস্ততার সূত্রে আমি বলব অত্যন্ত সফলতার সাথে জনাব সিরাজদৌলা খান সেই দায়িত্বটি পালন করেছেন।

যাই হোক আমাদের ইব্রাহিম ম্যানসনে যারা ঢাকায় তখন অবস্থান করত কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছাত্রলীগের বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা-তিনি খুব সংক্ষেপে বললেন-কারও বাড়িতে ডাকাতি হলে বাড়ির মালিক যদি ডাকাত দলের কারও নাম ধরে ডাক দেয় যে ‘তোকে তো চিনলাম’, তখন ডাকত দলের সামনে দুটো পথ খোলা থাকবে-১)ওই মালিককে মেরে ফেলা, যাতে গ্যাং কোনওদিন ধরা না পড়ে, অথবা ২)যাকে চিনছে তাকে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা। কারণ, একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সমস্ত গ্যাংটাকে ধরে ফেলা সহজ হবে।

সেরকম আমিও যখন ছয় দফা দিয়েছি তাদের সামনে দুটো পথ খোলা আছে-১) ছয় দফা মেনে নেওয়া, এটা কখনই তারা মেনে নিতে পারবে না, তাদের কলিজায় হাত দিয়েছি, তাদের শোষণ যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তারা মেনে নিতে পারে না। দ্বিতীয় পথ, আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলানো। আমি প্রস্তুত। কিন্তু আমি তোদের কাছ থেকে একটি অঙ্গীকার চাই। আমার সাথে মাটি নিয়ে শপথ কর যে আমার ফাঁসিকাঠে ঝোলার পর এই দেশে আন্দোলন স্তিমিত হবে না। ভারতে ক্ষুদিরামের ফাঁসি দেওয়ার পর সাময়িকভাবে কিছুদিনের জন্য আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেছে। আমি তোদের কাছ থেকে আশ্বাস পেতে চাই যে আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝূলানোর সাথে সাথে সারা বাংলাদেশে আন্দোলনের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। সেই আন্দোলনে যেন বাংলাদেশ স্বাধীন করে দেবে। স্বাধীনতার জন্য কাউকে না কাউকে তো জীবন দিতেই হবে। আমি সেই প্রথম ব্যক্তি হতে চাই। যে জীবন দেব।

উনি দূরদর্শী ছিলেন। ছয় দফা পেশ করার ঠিক আড়াই বছর পরে ১৫ দিনের মধ্যেই গ্রেফতার হয়ে যান। জেলে যাওয়ার আড়াই বছর পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ওনার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়। পাকিস্তানিরা যে ওনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল এটাই যথেষ্ট একটা দেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস দেখতে গেলে আয়ুব খানের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মূল কথা হল- সেখানে তিনিটি বড় অভিযোগ ছিল। ১) শেখ মুজিব এই দেশের ছাত্রসমাজকে উস্কানি দিয়ে এবং সশস্ত্রভাবে বিদ্রোহ করে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া তিনি শুরু করেছেন, ২) তিনি বাঙালি সৈন্যদের বিদ্রোহ করার জন্য উস্কানি দিয়ে যাচ্ছেন এবং বিদ্রোহ করে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য, ৩) এদেশের সিভিল প্রশাসন তাদেরও অনেককেই পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য তিনি সংগঠিত করছেন।

সেই কারণে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আসামি ছিল সেনাবাহিনীর ২৬জন। যারা ছোট পদে ছিল। তিনজন বাঘা বাঘা সিএসপিও এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হয়েছিল। আয়ুব খানের এই অভিযোগ পড়েলেই তো বোঝা যাবে কিভাবে দেশটা স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার ইতিহাস চলে আসে। তার অভিযোগ পড়লে।

আমার একটা স্মৃতি বলতে চাই-১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়া ইয়া খান যখন নির্বাচন ঘোষণা করলেন, তিনি শর্ত দিলেন এল এফ ফোর রিয়েল ফ্রেম ওয়ার। সেখানে তিনি মা্রাত্মক কথা বললেন-একটা বৈষম্যের কথা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানে যে বৈষম্য এই বৈষম্যের কথা কোথাও বলা যাবে না বললেই কোপে পড়বে। তাদের যে শোষণ আমাদের উপর এতদিনকার যে নির্যাতন এও বলা যাবে না। দ্বিতীয় যেটা দিলেন-তা হল, নির্বাচনের ছয় মাসের মধ্যে ১৮০ দিনের মধ্যে পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি করতে হবে। যদি তা না পারেন তাহলে এই পার্লামেন্ট আপনি আপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তার অর্থ তারা ভেবেছিল-যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। ভালো সংখ্যক সিট পাবে। মেজোরিটি সিট পাবে, উল্লেখযোগ্য সিট পাবে। একক মেজোরিটি হবে না। কাজেই তারা যদি সংবিধান তৈরি করেত না পারে ছয় মাস পরে আপনি আপনি সংসদ ভেঙে যাবে। ভেঙে গেলে মার্শাল চিরস্থায়ী হবে। ওদের দেশের রাজনীতিকরা রাজনীতি নিতে পারে না, সংবিধান তৈরি করতে পারে না। আমরা তো ফেলে দিতে পারি না অতল গহ্বরে। কাজেই তাদের উদ্ধার করতে আমরা ছাড়া তো কেউ নেই। এই ধারণা নিয়ে তারা নির্বাচন দিয়েছিল। আর নির্বাচনটা হয়ে গেল তাদের জন্য কাল। মানুষ এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ হল যে সমস্ত হিসেব-নিকেশ সবকিছুকে ব্যর্থ করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে তারা নির্বাচিত করল। তখন আর কোনও পথ না পেয়ে ক্ষমতাও হস্তান্তর করল না যার ফলে এই মুক্তিযুদ্ধে যেতে বাধ্য হলাম। আমাদের বিকল্প কোনও পথ ছিল না। আর ঐটি ছিল মোক্ষম সময়। কারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ।

এই শর্তে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি নির্বাচনে যাব। ছাত্রসমাজ আমরা একটু বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। যে এই শর্ত মেনে নেওয়া যাবে না।বঙ্গবন্ধু তখন বললেন-আমি দুটো কারণে আমি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে নির্বাচনে যেতে চাই না। দুটো কারণ-১) বাঙালির একক নেতা কে সেটা এই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত করা হোক। এবং বাঙালিরা বাংলাদেশ স্বাধীন চায় কিনা। তার উপর এটা গণভোট মনে করে আমি নির্বাচনে যাচ্ছি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে নয়। আমাদেরকে বললেন, তোদের দায়িত্ব গণভোট হিসেবে দেখে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট টানা। এবং নির্বাচনের সময় বক্তৃতা দেবেন সেটাও তিনি বলে দিলেন। যদি ছয় দফা না মানে তবে এক দফা। কাজেই বঙ্গবন্ধুরর নির্দেশে আমরা কিন্তু ‘৭০ সালেই সারা জাতিকে এক দফার আন্দোলনের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করি। ক্ষেত্র অনেক আগেই প্রস্তুত হয়েছিল।

এটা একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে হয়েছে। হিসেবে নিতে গেলে বলতে হবে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যে স্বাধীনতার ঘোষণার ইস্তাহার পাঠ করল মার্চ মাসের ২ তারিখ। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টন বাজারে। সেখানে লেখা ছিল বঙ্গবন্ধু হবে জাতির পিতা।জাতীয় সংগীত হবে-আমার সোনার বাংলা। জাতীয় পতাকা আজকে যেটা দেখছেন তার মধ্যে আবার বাংলাদেশের ম্যাপ ছিল। তারপরে বাংলাদেশের অর্থনীতি কি হবে, সামাজিক অবস্থা কি হবে, সেটা সেদিন স্বাধীনতার ইস্তাহারে পাঠ করেছিল ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। সভাপতিত্ব করেছিলেন নূররহম সিদ্দিকি। সাজাহান শেখ সেটি পাঠ করেছিলেন।

আমি ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করেছি যে ২৫ মার্চ ঢাকা শহরে যে তছনছ করেছিল। অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে। আমার নেতৃত্বে যুদ্ধ হয়েছে। আমরা অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি দখল করে নি। ব্রিগেডিয়ার জাহাঞ্জেবকে বিতাড়িত করে দি।

আমার বেশ মনে আছে সেই বক্তৃতাটা। অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির ডাইরেক্টর ছিলেন ব্রিগেডিয়ার করিমউল্লা। যখন আমরা চারদিক থেকে ঘেরাও করি। ওরা অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভিতরে ঢুকতে দেয় না। তখন বাইরে দাঁড়িয়ে আমি বলেছিলাম-আই ডু হেয়ারবাই ডিসমিস। ব্রিগেডিয়ার করিমউল্লা পোস্ট অফ ডাইরেক্টর বাংলাদেশ পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি। এন্ড ডু হেয়ার ওয়াইপন মিস্টার কাদের অ্যাজ ডাইরেক্টর। ব্রিগেডিয়ার করিমউল্লা পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। আর আসেনি। শাহাবজাদা ইয়াকুব আলিকে গাজীপুরে হেলিকপ্টার নিয়ে নামতে দিইনি। এগুলো করেছি স্বাধীনতার জন্য। এসব ঘোষণা মানুষকে উজ্জ্বীবিত করেছে। কিন্তু এগুলো কার্যকর ছিল না। আমরা যে ঘোষণা করেছি আমাদের কোনও এক্তিয়ার বা বৈধতা ছিল না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের মানুষকে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে তাকে যে কোনও সিদ্ধান্ত নেন বাঙালির পক্ষে। সেই ক্ষেত্রে একক নেতা হিসেবে নির্বাচিত হলেন। তাই তার একটা বৈধতা আছে। ভোটের ফলে তার একটা বৈধতা আছে। আমাদের কারও বৈধতা ছিলা না। আমাদের ঘোষণায় বক্তৃতায় মানুষ উজ্জ্বীবিত হয়েছে উৎসাহিত হয়েছে, উদবুদ্ধ হয়েছে কিন্তু মূল এক্তিয়ার বঙ্গবন্ধুর ছিল।সেই নির্বাচনে মানুষ ভোট দিয়ে সেই ক্ষমতাটা তাকে দিয়েছিল। ভোটের মাধ্যমে তিনি অধিকার লাভ করেছিলেন।

প্রতিবেদনটি সাক্ষাৎকার ভিত্তিতে লেখা। বাংলাদেশ সচিবালয়ে মন্ত্রীর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন স্নগবাদ প্রভাকর টাইমস-এর প্রধান সম্পাদক অনিরুদ্ধ পাল

Published on: মার্চ ১৭, ২০১৮ @ ০৯:২৬


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

34 + = 36