Published on: নভে ৮, ২০২২ @ ১৫:৫১
লেখকঃ রসিক গৌরাঙ্গ দাস
এসপিটি প্রতিবেদন: আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার দুইশত চল্লিশ বছর আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিশেষ সংখ্যাতত্ত্বের (পশ্চাৎগণনানুসারে) শ্রীধাম বৃন্দাবনের ধীরসমীরে, যমুনা তীরে বংশীবটমূলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রজগোপাঙ্গনাদের সঙ্গে অপ্রাকৃত রাসলীলা বিলাস করেছিলান। শারদীয়া পূর্ণিমার রাতে এই রাস নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই রাতে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি অপরূপসাজে সুসজ্জিত হয়েছিল। পূর্ণ চন্দ্রের স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে গগণমন্ডল উদ্ভাসিত। বৃক্ষ, লতা, গুল্মাদি, পশুপক্ষী উন্মুখ হয়েছিল। ভগবানের রাসলীলা দর্শনে। শ্রীকৃষ্ণের নরলীলা সমূহের মধ্যে সর্বোত্তম রাসলীলা। এই রাস নৃত্য ছিল সম্পূর্ণ চিন্ময়। তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র আট বছর।
কেমন ছিল সেই পরিবেশ
শ্রীকৃষ্ণ কেবল আনন্দময় ‘আনন্দময়োহভ্যাসাৎ’ বৃন্দাবনে সকলেই আনন্দময়। পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-লতা, জল-স্থল, গাভী, গোবৎস, গোপবাল এবং গোপবালিকারা সকলেই কৃষ্ণপ্রেমে আনন্দময়। শ্রীকৃষ্ণ কে ভালোবেসে তারা পরম আনন্দে মগ্ন।
ভগবানের ভগবত্তার নির্যাস হল মাধুর্য্যরস। যা পূর্ণরূপে প্রকটিত হয়েছে দ্বাপর যুগের শেষে কৃষ্ণলীলায়। শরতের শেষে বিশ্বপ্রকৃতি যেন আনন্দমগ্না। যমুনাপুলিন শরদজ্যোৎস্না দ্বারা বিধৌত।
বিশ্বপ্রকৃতির মনোমুগ্ধকর পরিবেশে শরৎ পূর্ণিমার রাতে বটমূলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বংশীবাদন শুরু করলেন। মন প্রাণ হরণকারী বংশীর দ্বনি শুনে ব্রজগোপীকারা তাঁদের পতি, পুত্র, গৃহকর্ম, জাতি, কুল-মান সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মহামিলনের জন্য রাসস্থলীতে ছুটে এসেছিলেন। ভগবানের সঙ্গে মিলনের জন্য এইরূপ ব্যাকুলতাই মানুষকে চরম সার্থকতা এনে দেয়। কৃষ্ণানুরাগে রঞ্জিত হয়ে ওঠাই ছিল ব্রজবালাদের একমাত্র সাধনা। শ্রীকৃষ্ণও নৃত্যানুষ্ঠানের উপযুক্ত স্থান-কাল-পাত্র-বিবেচনা করে মল্লিকা, জুঁই ও অন্যান্য অত্যন্ত সুগন্ধিযুক্ত পুষ্প দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করেছিলেন। অপ্রাকৃত রাসনৃত্য শুরু হল। রাসমন্ডলীতে দুই গোপী তাঁর মধ্যে কৃষ্ণ। যত গোপী তত কৃষ্ণ। রাসরসের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ।
‘নাচতঘন নন্দলাল রসবতী করি সঙ্গে।‘ এই রাসনৃত্যে বিশ্বভুবন নাচে।ফুলের উপর নাচে ভ্রমরভ্রমরী। মেঘের তালে নাচে ময়ূরময়ূরী। কদম্ব শাখায় নাচে শুক-শারী। বৃক্ষ-লতা, পশু-পক্ষী, জল-স্থল, আকাস-বাতাস আনন্দে নৃত্য করে গোপী-গোবিন্দের প্রেমের উদ্বেলতায়। এই চির য়ানন্দ খেলার বিরাম নেই। চলছে নিরন্তর নিরবিচ্ছিন্ন।
শ্রীকৃষ্ণ কে?
শ্রীকৃষ্ণ কে? সকল বিশ্বজীবের আন্তরে যিনি অধ্যক্ষ বা বুদ্ধি প্রভৃতির সাক্ষী, সেই পরমাত্মা আজ ক্রীরার তরে লীলা বিগ্রহধারী। সকলের অন্তরের অন্তরতম রূপে শ্রীকৃষ্ণ বিরাজমান। তাঁর কেউ পরম নেই। কি পুরুষ, কী নারী, সকলেরই হৃদয় বিহারী। তাঁর এই লীলা আত্মার সঙ্গে আত্মার বিহার। নিজের সঙ্গে নিজেরই খেলা। এই খেলা বিশ্বজুড়ে প্রতিনিয়ত চলছে। তাঁরই বৈচিত্রময় প্রকাশ রাসলীলা। গোপীদের ব্রতসাধনা, দীর্ঘদিনের তপস্যা, হৃদয়ে পুঞ্জীভূত অনুরাগের ফলে তাদের অনুগ্রহ করবার জন্যই শ্রীকৃষ্ণ এই রাসলীলা করেন।
ভুলে গেছি আত্মানুসন্ধানের যথার্থতা
বর্তমানে আমরা একবিংশ শতাব্দীর সভ্য মানুষ। আত্মসুখের আয়োজনে তৎপর। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর মানুষ। সব কিছুই আমাদের হাতের মুঠোয়। আমরা ছুটে চলেছি বিশ্ব বিজয়ে। চলছে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা। চাহিদা বেড়ে চলেছে ভোগ্য বস্তুর। ভুলে গেছি আত্মানুসন্ধানের যথার্থতা। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে জানতে চাই শ্রীভগবানের রাসলীলা রহস্য। অথচ মন ছুটে চলে জড় জাগতিক বিকৃত কদর্য রসের দিকে।
কিন্তু এর বাইরে যে জগৎ আছে, তোমরা নিজেরাই জানো না। জগতের কেউ সুখী নয়। সুরভিত চির বিকাশ্মান পুষ্পের মতো জীবনের আরেক রূপ যথার্থ বাস্তব জীবন। যা শাশ্বত, জরা-ব্যাধি মৃত্যুহীণ। এইজীবনেই তা লাভ করা সম্ভব।