আইভিএস-এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীভগবানের ৮৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন, কলকাতার রাজপথে বর্ণাঢ শোভাযাত্রা

Main দেশ ধর্ম রাজ্য
শেয়ার করুন

Published on: জানু ৪, ২০২৪ at ২৩:২৫ 
Reporter: Aniruddha Pal

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ৪ জানুয়ারি: ইন্টারন্যাশনাল বেদান্ত সোসাইটি (র প্রতিষ্ঠাতা শ্রীভগবানের ৮৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হল ৩রা জানুয়ারি ২০২৪ এ। এই উপলক্ষ্যে কলকাতার রাজপথে শ্রীভগবানের ভক্ত-অনুরাগী-গুণমুগ্ধরা এক বর্ণাঢ শোভাযাত্রায় অংশ নেন। কলকাতায় মহাজাতি সদনে এদিন দেশ-বিদেশের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী, সাধু-সন্ত এবং ব্রহ্মচারীদের উপস্থিতিতে এক আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলে দিনটি খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন ইন্টারন্যাশনাল বেদান্ত সোসাইটি।বিগত ৩৫ বছর ধরে উপনিষদের মতাদর্শ ও শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই সোসাইটি জনসমাজে কাজ করে চলেছে। এদিন অনেক বিখ্যাত সাধু ও পন্ডিত ভগবানের শিক্ষা সম্পর্কে তাদের মতামত উপস্থাপন করেছেন যা দেখিয়েছে যে এই আধ্যাত্মিক জ্ঞান কতটা প্রাসঙ্গিক, যা প্রতিটি মানুষকে আধুনিক সমাজে ভয়ংকর চাপের মুখে একটি ভাল, স্বাস্থ্যকর এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে সাহায্য করতে পারে।এদিনের অনুষ্ঠানে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল সংঘজননী গুরুমাতার মূল্যবান বক্তব্য, যা উপস্থিত সকলকে মোহিত করে দেয়।

কলকাতার রাজপথে ভগবানের শোভাযাত্রা

এদিনের অনুষ্ঠটি বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে নেওয়া হয়েছিল, যেখানে প্রতিষ্ঠাতার অবদান এবং শিক্ষাকে প্রদর্শিত করে। বিশ্ব শান্তির জন্য বেদমন্ত্রের বিশেষ প্রার্থণার মধ্য দিয়ে দিনটি শুরু হয়। এদিনের অনুষ্ঠানে একটি প্রদর্শনী হয় যেখানে প্রতিষ্ঠাতার কৃতিত্ব এবং তাঁর জীবনের মাইলফলকগুলি প্রদর্শন করে। এদিন নজর কাড়ে কলকাতার রাজপথে শ্রীভগবানের শোভাযাত্রা। যেখানে ঢোল এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের সাথে ভগবানের নাম-যপ ও গানে রাজপথে এক রোমঞ্চক মুহূর্ত তৈরি করে।

চারটি বই এবং ক্যালেন্ডার প্রকাশিত হয়

এদিনের অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক বেদান্ত সোসাইটি তাদের বাংলা ম্যাগাজিন “শোনো বিশ্ববাসী” এবং ইংরাজি পত্রিকা “সত্যেনো পন্থা” প্রকাশ করে। এই প্রকাশনাগুলি উপনিষদের শিক্ষায় পুর্ণ এবং শ্রীভগবানের জীবন ও শিক্ষার অন্তর্দৃষ্টি দেয়। এছাড়াও আরও দুটি বই প্রকাশিত হয়। হিন্দিতে “শ্রীভগবান উবাচ-পার্ট-২” েবং বাংলায় “ভগবান বচনামৃত”।অনুপ শ্রীবাস্তব শ্রীভগবান উবাচ বইটি বাংলা থেকে হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন এবং স্বামি সচ্চিদানন্দ শীভগবানের শিক্ষাকে নতিবদ্ধ করে “ভগবান বচনামৃত” বইটি প্রকাশ করেছেন। পরে স্বামী সচ্চিদানন্দ বইটি সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা কথা স্কলের সঙ্গে ভাগ করে নেন।

পারমার্থিক জাগরণই কিন্তু ঈশ্বর দর্শন-স্বামী সচ্চিদানন্দ

স্বামী সচ্চিদানন্দ বলেন- “এই বইটির কাজ তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু করেন। বইটির নাম ‘ভগবান বচনামৃত’ নামটিও ভগবান অপরিবর্তিত রাখার নির্দেশ দিয়ে যান।এই আধ্যাত্মক জগতে ভগবান প্রায়ই বলতেন- একটা পারমার্থিক জাগরণ লাগে। আমরা আধ্যাত্মিক জগতের অনেক বই পড়তে পারি। অনেক সাধনা করতে পারি। অনেক ধ্যান-ধারণা করতে পারি। বেদ-উপনিষদ পড়তে পারি। কিন্তু যতক্ষণ আমাদের পারমার্থিক জাগরণ হচ্ছে সব কিছু বৃথা হয়ে যাবে। ভীষণ দরকার এই পারমার্থিক জাগরণ। পারমার্থিক জাগরণই কিন্তু ঈশ্বর দর্শন। এও পারমার্থিক জাগরণই কিন্তু সমাধি। ভগবানের কাছে এসে এখানে সমাধি হয়। স্বামীজী বলছেন- উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাস্প্য বরান নিবোধতঃ। ওঠ, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত থেমো না। আমরা ঘুমিয়ে আছি। জাগতে হবে। এই জাগরণের জন্যই কিন্তু আধ্যাত্মিক সাধনা। এই সাধণার জন্য আমরা আধ্যত্মিক পথে চলি।”

তিন বিদেশী নারী সন্ন্যাস গ্রহণ করেন

এদিন তিন বিদেশী নারী সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। লন্ডনের মিস লরা ট্রুপ হন ব্রহ্মচারিণী জাহ্নবী মা, নেদারল্যান্ডের মিস ফ্রুকজে কোকে হন ব্রহ্মচারিণী প্রভা মা এবং ইন্দোনেশিয়ার মোনিতা হন ব্রহ্মচারিণী শ্রদ্ধাপ্রাণা মাতা। ভগবানের বেদান্ত শিক্ষা তাদের জীবনকে যে শান্তির পথ দেখিয়েছে সেটাই বলেন ইন্টারন্যাশনাল বেদান্ত সোসাইটির এক সন্ন্যাসী।

স্নেহময়ী মাতা তাঁর নিজের হতাশাপূর্ণ জীবন কিভাবে শ্রীভগবানের দেখানো পথ ধরে কাটিয়ে উঠেছিলেন তা বলেন।ইন্টারন্যাশনাল বেদান্ত সোসাইটির মহিলা শাখার আহ্বায়ক তথা শ্রীভগবানের কন্যা দেবজানী চক্রবর্তী জানান তার মতামত।

বেদান্তকে বুকে নিয়ে তিনি মেয়েদের এগিয়ে যেতে বলেছেন-দেবযানী চক্রবর্তী

দেবযানী চক্রবর্তী ভগবানকে স্মরণ করে বলেন-“তিনিই শিখিয়েছেন ঈশ্বরই একমাত্র সত্য। আমরা সেই শুদ্ধ-মুক্ত-নিত্য-বুদ্ধ আত্মা। আমরা এই জীবনেই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করি। এখানে দাঁড়িয়েও ঈশ্বরকে উপলব্ধি কর‍্তে পারি। তিনি আছেন। সবার মাঝখানে আছেন। তিনিই কথা শুনছেন। তিনই বলাচ্ছেন। সব জায়গায় তিনি ছড়িয়ে আছেন। আমাদের বিভিন জায়গায় আশ্রম আছে। প্রত্যকেটা ভালোবাসার পিছনে তিনি। তাকে নিয়েই আমরা আমাদের বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। বেদান্তকে বুকে নিয়ে তিনি মেয়েদের এগিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা ইন্টারন্যাশনাল বেদান্ত সোসাইটির মেয়েরা মনে-প্রান্বে বিশ্বাস করি সেই সত্যকে অনুভব করা যায়। ঈশ্বরকে অনুভব করা যায়। এখানে যেমন সন্ন্যাসীরাও যেমন আছে তেমনই গৃহস্থরাও রয়েছে। ভগবন আমাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন যে এখনও এই প্ররথিবীতে তাকে অনুভব করা যায়। তাকে অনুভব করতে পারাটাই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।”

ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের দেখা পেয়েছিলেন শ্রীভগবান- স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ

ইন্টারন্যাশনাল বেদান্ত সোসাইটির প্রকাশনা বিভাগের সম্পাদক প্রজ্ঞানানন্দ তুলে ধরেন শ্রীভগবান সম্পর্কে তাঁর নিজের কথা। তিনি বলেন- একজন রাজাধিরাজ তিনি যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান তখন চারদিকে রাস্তার দিকে তাকাই তখন বোঝা যাবে যে তিনি হেঁএটে গেছেন। কেননা তিনি যখন যান তখন চারদিকে মণিমুক্ত ছড়িয়ে যান। মহাপুরুষরা তাঁর জীবন কাটান এই পৃথিবীতে তখন তারাও সেই মণিমুক্ত ছড়িয়ে যান। ভগবানের ক্ষেত্রেও তাই। অবতার পুরুষদের ক্ষেত্রেও তাই। ছোটবেলা থেকেই আমরা যদি তাঁর জীবনকে বিশ্লেষণ করি আমরা সেখানেও অনেক মণিমুক্তোর খোঁজ পাব। তাঁর জীবনে ছোটবেলায় যখন নিদারুণ দরিদ্রতা সেই সময় দেখছি যে তিনি তাঁর সঙ্গীসাথীদের জুটিয়ে বিরাটি স্টেশনে যারা তৃষ্ণার্ত ট্রেনযাত্রী তাদের কাছে ঠান্ডা পানীয় জল নিয়ে যাচ্ছেন। বিনামূল্যে। তখন থেকেই তাঁর ভিতর পরমার্থের ভাবনা।”

“তাঁর পৈতে হল। পৈতের পরদিন তিনি তাদের বাড়িতে মুসলমান চাকর ছিলেন তার বাড়িতে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি অন্ন গ্রহণ করলেন।দেখলেন জাত যায় কিনা। আর একটু বয়স হল- চাকরি জীবনে ঢুকলেন। তাঁর অধস্তন কর্মীদের যারা নিপীড়িত-শোষিত তাদের সমস্যা নিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতেন। তারা তাঁর কথা শুনতেন। তাকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারত না। তাকে সবাই ভয় পেত।”

আরও বলে চলেন স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ। বলেন- “গুরু ছাড়া আধত্মিক পথে এগোনো যায় না। গুরু প্রাপ্তির আগেই শ্রীভগবানের ইষ্ট প্রাপ্তি হল। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের দেখা পেলেন তিনি। ঠাকুর রামকৃষ্ণ ছিলেন ভগবানের ইষ্ট। ঠাকুর তাকে দর্শন দিলেন। তাকে স্পর্শ করলেন। তাকে আশীর্বাদ করলেন। তোর সব হবে। তখনও তিনি গুরু পাননি। তারও বেশ কয়েক বছর পর তিনি গুরুকে পেয়েছেন। গুরুকে পাওয়ার পর মাত্র তিনদিনের সাধনায় তিনি নির্বিকল্প সমাধি লাভ করলেন। যেটা চিন্তারও বাইরে। কারণ, বছরের পর বসে মানুষের একটু ধ্যান হতে চায় না। সেখানে ধ্যান-সমাধি, নির্বিকল্প সমাধি যা কিনা সমাধির চরম অবস্থা সেটা তিনি লাভ করলেন। এবং তাঁর স্ত্রীকে সাথে রেখে। যিনি আমাদের সংঘজননী গুরুমা। তার দু’আড়াই বছর পর মহাভাব হল। সেই মহাভাব শরীরে ধারণ করলেন। যাকে সাধারন কোনও সাধক কিংবা সিদ্ধপুরুষও ধারণ করতে পারে না। সেই মহাভাব তিনি ধারণ করলেন। তার মধ্যে এক ঈশ্বরীয় মহাশক্তি ফেটে পড়ল।”

শান্তির পথ অবলম্বন হচ্ছে একমাত্র ঈশ্বরের পথ- সঙ্ঘজননী গুরুমাতা

সঙ্ঘজননী গুরুমাতা তুলে ধরেন তাঁর অমূল্য বক্তব্য। বলেন- “ভগবান সারাজীবন সত্য-আধ্যাত্মিকতাকে নিয়ে কাটিয়েছেন। মানুষকে ভালবেসেমানুষের মনে ছুঁইয়ে গেছেন। গত বছরও তিনি ছিলেন। আজ নেই। কিন্তু তার একতা অনুভব সবাই করতে পারছে। ভগবান আছে। সব জায়গায় আছে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই বেদান্ত সোসাইটি তৈরি করেছেন। এই বেদান্ত সোসাইটি তাঁর প্রান। অনেক ঝামেলা গেছে। ভগবান ভেবেছিল রাখতে পারব না, বেদান্ত সোসাইটি। কিন্তু এটা তো দ্বৈব শক্তির একটা প্রভাব। তাই ভগবান এটাকে ছাড়তে পারেনি। এটা নিয়েই ভগবান সারা জীবন চলেছে। সবাইকে বলেছে এই বেদান্ত সোসাইটিতে যুক্ত হতে।”

“আমাদের সন্ন্যাসীরা যখন ছোট ছিল তারা ভগবানের কাছে ছুটে ছুটে আসত। তারা এখন ভগবানের কাজ কছে। ভগবনাএর কাজ সারা বিশ্বে ছরিয়ে পড়েছে। তিনি অনুভব করেছিলেন মানুষই ভগবান। ঈশ্বরকে ভালোবাসলে আমরা সবাইকে ভালোবাসতে পারব। ভগবান সত্য নিয়েই থেকেছে। ঈশ্বেরকে নিয়ে যত থাকবে মনের গ্লানি দূর হয়ে যাবে। শুধু স্থির থাকতে হবে। চঞ্চল হলে চলবে না। যত শান্ত থাকব ততই কাজগুলো আমাদের সুন্দর হবে। চঞ্চল হলে হবে না। তাই শান্ত হও। শান্তিতে রাখো। সুখ জীবনে বেশিক্ষন টেকে না। আজ সুখ এলে কাল দুঃখ এসে যায়। তাই শান্তির পথ অবলম্বন হচ্ছে একমাত্র ঈশ্বরের পথ।“ বলেন গুরুমাতা।

শ্রীভগবানের ৮৩তম জন্মবার্ষিকীতে রাম ভজন গেয়ে শ্রদ্ধা জানান অদ্বৈত সিনহা। লালন ফকিরের ‘আমার মনের মানুষ’ গানটি গেয়ে শ্রীভগবানের জন্মদিন উদযাপনকে আরও সমৃদ্ধ করেন বাউল শিল্পী দীপঙ্কর চক্রবর্তী।ভগবানের একটি প্রিয় গান গেয়ে শোনান ইশানি মিত্র। এই গানটি ভগবান খুবই পছন্দ করতেন।

আইভিএস-এর মিশনকেও শক্তিশালী করেছে

সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি ইন্টারন্যাশনাল বেদান্ত সোসাইটি তাদের অঙ্গীকারের অংশ হিসাবে আইভিএস একটি কমিউনিটি আউটরিচ প্রোগ্রামেরও আয়োজন করে। সংঠনের নিবেদিতপ্রাণ যুবসমাজের অভ্যন্তরীণ গঙ্গাসাগরের এক প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছন এবং জ্যাকেট বিতরণ করেন। সেই সংগে শিক্ষা গ্রহণের প্রতি উৎসাহিত করেন। এই ক্রিয়াকলাপগুলি কেবল প্রতিষ্ঠাতার পরোপকারী চেতনাকে সম্মানিত করেনি বরং দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির আইভিএস-এর মিশনকেও শক্তিশালী করেছে।

 

Published on: জানু ৪, ২০২৪ at ২৩:২৫

শেয়ার করুন