দক্ষিণীবার্তায় প্রিয়দার সঙ্গে, মনে পড়ছে কত কথা–

দেশ
শেয়ার করুন

অরুণাভ গুপ্ত

আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি দক্ষিণীবার্তা সাময়িক পত্রিকায়।প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী ছিলেন সম্পাদক এবং মূল কাণ্ডারী। সহযোগী সম্পাদক মিহিরকিরণ ভট্টাচার্য ছিলেন আমার ক্লাসমেট এবং ওঁর হাত ধরেই প্রিয়দার কাছে যাওয়া। আলাপ পরিচয়ের আগে প্রিয়দার সাদর সম্ভাষণ- ‘আয়, মিহির তোর কথা বলেছে। তুই খেলার পাতার দায়িত্বে থাক। লেগে পড়। বুঝলি অরুণ-মনে রাখিস ছোট পরিবার সুখী পরিবার।’ ঐ নামেই প্রিয়দা আমাকে ডাক্তেন। মুহূর্তে আপন হয়ে গেলেন। শুরু হল লেখালেখি। প্রথমে ছিল ট্যাবলয়েড সাইজ। পরে পত্রিকার আকার নেয়। পাগলের মত কাজ করতাম। অফিস আওয়ার্সের পরে সোজা প্রেস। ঝাঁপ বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত লেখালিখি প্লাস গুলতানি। প্রেসের মালিক ছিলেন প্রদীপ হাজরা।অমায়িক বিরাট ছাতির মানুষ। মনে হত বাড়িতে বসে কাজ করছি।

উত্তর থেকে দক্ষিণ কত হোর্ডিং কত প্রচার।দক্ষিণীবার্তা এক ডাকে সবাই চেনে। কে না লিখেছেন সেখানে। নামি-দামি সব্বাই।মূল কেন্দ্রবিন্দুতে একটি চরিত্র- প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী। বিনা পারিশ্রমিকে প্রতিটি সাহিত্যিক লেখা দিতেন। এমনকি উপন্যাস পর্যন্ত। কোনও দায়সারা গোছের নয়। রীতিমতো ক্লাস লেখা। ওঁরা জানতেন প্রিয় বা প্রিয়বাবুর জন্য পুজো সংখ্যায় একটা লেখা বরাদ্দ রাখতেই হবে। কি যে ভালবাসতেন ওঁরা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। ওঁরা বলতেন, আগাপাছতলা রাজনীতির মানুষ এত সাহিত্য প্রেমিক হলেন কি করে! সত্যি কথা। আমি নিজের চোখে তাঁর লাইব্রেরি দেখেছি। কত বই ভাবা যায় না। বলতাম, প্রিয়দা, সব পড়েছেন, মানে পড়ার সময় পান? তাৎক্ষনিক উত্তর আসত-‘না পড়লে রাখব নাকি, টেস্ট করে দেখতে পারিস।’ পরবর্তী পর্যায়ে তার অজস্র প্রমাণ পেয়েছি যখন দেখতাম গড়গড়িয়ে উপন্যাস লিখে ফেলছেন। কোথায় এতটুকু হোচট খাওয়ার ব্যাপার নেই। মহালয়ার সকালে শারদীয়া পত্রিকা দক্ষিণীবার্তার উদ্বোধন উপলক্ষে বিশাল বিচিত্রানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হত। সেখানেও যশস্বী শিল্পী, কলাকুশলী নানান অঙ্গনের উপস্থিতি চোখ ধাঁধিয়ে দিত। কেন আসতেন ওঁরা, ওই যে অদ্ভুত একটা স্নেহ-ভালবাসা তলায় তলায় নিঃশব্দে কাজ করত। আমার প্রথম লেখা শারদীয়ায়–‘লাল-হলুদ ডোরাকাটা সমরেশ চৌধুরী।’ প্রিয়দার অর্ডার ছিল-‘ওকে নিয়ে তোর যাত্রা শুরু কর।আমার ফেবারিট খেলোয়াড়।’ প্রকৃত যশাদের সঙ্গে আমিও জীবনে প্রথম মঞ্চে উঠে সন্মানণা নিলাম। কত উপহার। তবে উত্তরীয় ছিল মাস্ট। অতিথির হাত থেকে উপহার নেওয়ার সময় প্রিয়দার ঘোষণা-‘আমাদের উঠতি এই ক্রীড়া সাংবাদিক খুব ভাল লিখছে। ওর সাফল্য কামনা করি।’ কে আমি! সদ্য পোড়া কাপড়ের গন্ধ ম-ম করছে সারা শরীরে। তাকেই কিনা অনাবিল প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী, প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে হাততালির বন্যা। মঞ্চে ওঠার সময় হাত-পা ঠকঠকিয়ে কাঁপছিল। আর এটা শোনার পর আমার ধরনী দ্বিধাহ অবস্থা।

অসংখ্য টুকরো টুকরো ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি। যেমন একটা ঘটনা- আমার আর মিহিরের প্রথম খেলার বই বেরোয় খেলার কাগজ দীপ্তি প্রিন্টিং থেকে। ‘এক নজরে এশিয়াড-১৯৮২-র এশিয়াড ‘। প্রিয়দাকে বললাম-দাদা, দয়া করে একটা ভূমিকা লিখে দিন। প্রিয়দার প্রত্যুত্তর-‘লিখতে থাক, গড়গড়িয়ে বলে গেলেন। তারপর শেষ করার ভারটা আমার উপর ছেড়ে দিয়ে বললেন-‘হ্যাঁ-রে ভুলভাল তথ্য দিস নি তো!’ বলেই হেসে ফেললেন ঝড়ঝড়িয়ে। এমন মানুষকে ভোলা যায় না, ভোলা অসম্ভব।

প্রিয়দা বক্তৃতার সময় রেশ টানতেন এই বলে-‘যতদিন গঙ্গায় অবিশ্রান্ত জলধারা বইবে, যতদিন মসজিদে মসজিদে মিষ্টি-মধুর সুরে নামাজ পড়া হবে ততদিন আমাদের কংগ্রেস অক্ষত থাকবে।’আমি বলি-আমাদের প্রত্যেক সাহিত্য প্রেমীর মনে এই ভাবেই প্রিয়দা বেঁচে থাকবেন।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

82 + = 89