
1893 খৃষ্টাব্দের 11 সেপ্টেম্বর- শিকাগো ধর্ম-মহাসভার প্রথম দিনের অধিবেশনে সভাপতি কার্ডিনাল গিবনস শ্রোতৃমন্ডলীর নিকট স্বামী বিবেকানন্দের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর শুরু করেন তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।
Published on: সেপ্টে ১১, ২০২০ @ ১৯:৫৩
Reporter: Aniruddha Pal
এসপিটি নিউজ: যা কিছু ভালো তা সর্বসময় সর্বকালে সর্বক্ষণে ভালোই থেকে যায়। তার কোনও পরিবর্তন হয় না। আর তাই বিশ্বের বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যুগনায়ক স্বামী বিবেকানন্দের কথাগুলি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। আজ থেকে 127 বছর আগে ভারতের প্রাচীন সন্ন্যাসী সমাজের প্রতিনিধি হয়ে সুদূর আমেরিকায় শিকাগো ধর্ম মহাসভায় দাঁড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে মহামূল্যবান কথা বলেছিলেন স্বামীজী। তাঁর সেই ভাষণে কখনও ঝড় উঠেছে আবার কখনও আবার শান্ত-স্নিগ্ধতায় ভরে গিয়েছে। কখনও গৌরবান্বিত হয়েছেন আবার কখনও তাঁর গলাতে দুঃখের করুণ নিনাদ বেজেছে। আসুন সেদিন স্বামীজীর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসা মূল্যবান সেই কথাগুলি আরও একবার জানার ও বঝার চেষ্টা করি।
অসাধারণ সম্ভাষণ
ঐতিহাসিক সেই দিনটি ছিল 1893 খৃষ্টাব্দের 11 সেপ্টেম্বর। বক্তৃতার শুরুতেই স্বামীজী সেদিন ধর্ম মহাসভায় দাঁড়িয়ে প্রথমেই তাঁর উজ্জ্বল ব্যাক্তিত্ব আর ভারতীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সনাতন হিন্দু ধর্মের সুনামকে সামনে রেখেই এক নিমেষে গোটা প্রেক্ষাগৃহের শুধু নয় আপামর আমেরিকাবাসীর হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন- ‘আমার আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ’ এই শব্দ কটি উচ্চারন করে।এরপর স্বামীজী ্তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেন-“আপনারা আমাদের যে আন্তরিক ও সাদর অভ্যর্থনা করেছেন, তার উত্তর দেওয়ার দেওয়ার জন্য আমার সমস্ত হৃদয় অনির্বচনীয় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন সন্ন্যাসী-সমাজের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
সনাতন হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন
ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পর স্বামীজী অভ্যর্থনার জবাবে সনাতন হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন। কিছু বক্তা যারা স্বামীজীর সম্পর্কে সেদিন বিরূপ মনোভাব দেখানোর ইঙ্গিত প্রকাশ করেছিলেন তিনি তাদের প্রতি বরং সৌজন্যবোধ দেখিয়েছিলেন আর বলেছিলেন-“এই সভামঞ্চে সেই কয়েকজন বক্তাকেও আমি ধন্যবাদ জানাই, যাঁরা প্রাচ্যদেশীয় প্রতিনিধিদের সম্বন্ধে এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করবেন যে, অতি দূরদেশবাসী জাতিসমূহের মধ্য থেকে যাঁরা এখানে উপস্থিত হয়েছেন, তাঁরাও বিভিন্ন দেশে পরধর্ম-সহিষ্ণুতার ভাব প্রচার গৌরব দাবি করতে পারেন।”
নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন স্বামীজী
এরপর তিনি ভাষণে তুলে ধরেন সনাতন হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যের কথা। সেই ধর্মের প্রতিনিধি হওয়ার জন্য নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন স্বামীজী। তিনি বলেন-“যে ধর্ম জগতকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়ে আসছে , আমি সেই ধর্মভুক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করি। যে ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভাষায় ইংরেজী ‘এক্সক্লুশন’ (ভাবার্থঃ বহিষ্করণ, পরিবর্জন) শব্দটি অনুবাদ করা যায় না, আমি সেই ধর্ম্ভুক্ত বলে গর্ব অনুভব করি।যে জাতি প্ররথিবীর সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী জনগণকে চিরকাল আশ্রয় দিয়ে এসেছে, আমি সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি।”
সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন আরও কিছু সত্য কথা বলে
এখানেই থেমে থাকেননি সেদিন যুগনায়ক স্বামী বিবেকানন্দ। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক সভায় দাঁড়িয়ে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন আরও কিছু সত্য কথা বলে। যে কথা বলে স্বামীজী সেদিন গর্ব অনুভব করেছিলেন। আজ বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমাদেরও তাঁর প্রতিনিধি হয়ে সমানভাবে গর্ব অনুভব করার অবস্থানকে অক্ষুন্ন রাখা উচিত।সেদিন স্বামীজী বলেছিলেন- “আমি আপনাদের একথা বলতে গর্ব অনুভব করছি যে, আমরাই ইহুদীদের খাঁটি বংশধরদের অবশিষ্ট অংশকে সাদরে হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছি, যে বছর রোমানদের ভয়ঙ্কর উৎপীড়নে তাদের পবিত্র মন্দির বিধ্বস্ত হয়, সেই বছরই তারা দক্ষণ-ভারতে আমাদের মধ্যে আশ্রয়লাভের জন্য এসেছিল। জরথ্রুস্টের অনুগামী মহান পারসীক জাতির অবশিষ্টাংশকে যে ধর্মাবলম্বীরা আশ্রয় দান করেছিল এবং আজ পর্যন্ত যারা তাদের প্রতিপালন করছে, আমি তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।”
এক প্রাচীন সংস্কৃক শ্লোক উদ্ধৃত করেন স্বামীজী
সেদিনের ভাষণে এই কথাগুলি বলেই দায় সারেননি স্বামীজী। তিনি এর ব্যাখ্যাও দেন রীতিমতো এক প্রাচীন সংস্কৃক শ্লোক উদ্ধৃত করে। যে শ্লোক তিন শৈশব থেকেই আবৃত্তি করে আসছেন সেই শিবমহিস্ন স্ত্রোত্রম উচ্চারন করেন-‘রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং।নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব।।’ অর্থাৎ – বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু তারা সকলেই যেমন এক সমুদ্রে তাদের জলরাশি মিলিয়ে দেয়, তেমনি হে ভগবান, নিজ নিজ রুচির বৈচিত্রবশতঃ সরলো কুটিল নানা পথে যারা চলছে, তুমিই তাদের সকলের একমাত্র লক্ষ্য।
নিজের উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশের পাশাপাশি জানিয়েছিলেন প্রার্থণা
সবশেষে তিনি যে কথাগুলি উচ্চারন করে নিজের মত প্রকাশ করেছিলেন তা আজকের প্রেক্ষাপটে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বামীজী ১২৭ বছর আগে যে অবক্ষয় দেখেছিলেন সাম্প্রদায়িকতা গোঁড়ামি নিয়ে যে উন্মত্ততা লক্ষ্য করেছিলেন তা নিয়ে তিনি সেদিনের ধর্ম মহাসভায় দাঁড়িয়ে নিজের উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশের পাশাপাশি জানিয়েছিলেন প্রার্থণা। তিনি বলেছিলেন-“সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করে রেখেছে। এরা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করেছে, বারবার একে নরশোণিতে সিক্ত করেছে, সভ্যতা ধ্বংস করেছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করেছে। এইসব ভীষণ পিশাচগুলি যদি না থাকত, তা হলে মানবসমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হত। তবে এদের মৃত্যুকাল উপস্থিত। এবং আমি সর্বতোভাবে আশা করি, এই ধর্ম-মহাসমিতির সম্মানার্থে আজ যে ঘণ্টাধ্বনি বাজছে, তাই সর্ববিধ ধর্মোন্মত্ততা, তরবারি অথবা লেখনীমুখে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রকার নির্যাত্ন এবং একই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর ব্যক্তিদের মধ্যে সর্ববিধ অসদ্ভাবের সম্পূর্ণ অবসানের বার্তা ঘোষণা করুক।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ করলেন ট্যুইট
এদিন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এক ট্যুইট করে স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। তিনি লেখেন-“এই দিনটি মহান ভারতীয় দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক প্রতিভা স্বামী বিবেকানন্দের ঐতিহাসিক শিকাগো ভাষণের 127 তম বার্ষিকী উপলক্ষে। তাঁর জোরালো সম্বোধনটি একটি রূপান্তরকামী এবং আলোড়নকারী মুহূর্ত ছিল যা সমগ্র বিশ্বকে মানবতার একটি নতুন ধারণার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।”
https://twitter.com/AmitShah/status/1304231119395545088
Published on: সেপ্টে ১১, ২০২০ @ ১৯:৫৩