সাত মাসের সন্তান-সম্ভবা মা আজ বিপন্ন- কোথায় আছি আমরা

Main উত্তর সম্পাদকীয় কোভিড-১৯ দেশ
শেয়ার করুন

লেখক- অনিরুদ্ধ পাল
Published on: মে ৬, ২০২০ @ ২২:৫৭

এই প্রশ্ন আজ উঠছে। ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে কেন এই ছবি দেখতে হচ্ছে? লকডাউনে যানবাহন বন্ধ। পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য অন্যত্র গিয়ে আটকে পড়েছেন অনেকেই। আজ তাদের হাতে টাকা নেই। ঘরে ফিরতে আজ তারা হাঁটা শুরু করেছেন। ইতিপূর্বে এক ১২ বছরের শিশু বাড়ি যেতে গিয়ে রাস্তাতেই পড়ে মারা গিয়েছে।আবার আজ দেখা গেল এক সন্তান-সম্ভবা মা শারীরিক কষ্ট স্বীকার করে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথ হাঁটা শুরু করেছেন। এনডিটিভি সেই মর্মান্তিক দৃশ্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। সেই গর্ভবতী মায়ের কথা শুনে মাথা নত হয়ে আসছিল। সত্যি আমরা কোথায় আছি- যেখানে এক সন্তান সম্ভবা মা’কে এভাবে কষ্ট যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। সব জেনেও কারও কিছু করার দায় নেই। দেখা যাচ্ছে না অতিসক্রিয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের। হাওয়া হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতারাও।

পরিযায়ী শ্রমিকরা পেটের জন্য রুজি-রোজগারের আশায় ঘর ছেড়ে দূর এলাকায় গিয়েছিলেন। আজ তাদের রুজি-রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। টাকা-পয়সা কিছুই নেই। খাবারও সেভাবে জুটছে না। কতদিন এভাবে পড়ে থাকবে। স্পেশাল ট্রেন দিলেও সেখানে জায়গা হচ্ছে না সকলের। বাধ্য হয়ে তারা বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করেছেন। কেউ ৫০০ কিলোমিটার তো কেউ আবার আরও বেশি পথ অতিক্রম করার লক্ষ্য নিয়ে হেঁটে চলেছেন। কারও কাঁধে রয়েছে ভারী ব্যাগ, আবার কারও সঙ্গে আছেন শিশু-সন্তান। দলে কিছু অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরাও আছে। সবাই বাড়ি পৌঁছতে চায়। তারা প্রশাসনের কাছে গিয়ে অনেক কাকুতি-মিনতি করেছে। আরও অনেককে জানিয়েছে তাদের সমস্যার কথা।কিন্তু কোনও ফল হয়নি। কারণ তারা পরিযায়ী শ্রমিক। কেউ তাদের কথা শোনেনি। কারণ তাদের পিছনে কোনও নেতা-মন্ত্রীর খাস লোক নেই। তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কারণ তাদের এই সমাজ স্বার্থ বুঝে কাজে লাগায়। এখন স্বার্থ ফুরিয়েছে তাই তাদেরও দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

আর তার করুণ পরিণতি স্বীকার করে নিতে হচ্ছে এই মানুষগুলিকে। কেউ কেউ আবার অতি দয়াপরবশ হয়ে নিজের এলাকায় সামান্য পরিমানে খাবারের ব্যবস্থা করে সেই ছবি আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে ঘৃণ্য রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ এই ধরনের মানুষগুলি যাদের পেটে খাবারের দানা পর্যন্ত পড়ছে না যাদের চোখে ঘুম পর্যন্ত নেই যাদের শরীর পর্যন্ত ভেঙে পড়ছে ক্রমে তাদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মতো নেতা-কর্মীদের আজ বড়ই অভাব। কী বিচিত্র এই সমাজ।

যেখানে আজ ১২ বছরের ছোট্ট মেয়েটিকে পেটের ভাত জোটাতে মধ্যপ্রদেশ থেকে তেলেঙ্গানায় লঙ্কা তুলতে যেতে হয়। আর লকডাউনে তাকে বাড়ি পৌঁছতে হাটা শুরু করতে হয়।টানা ১০০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছে অবলীলায়। চোখের সামনে বাবা-মায়ের মুখ ভেসে এসেছে। কখন পৌঁছবে বাড়ি। পেটে একটি দানা পর্যন্ত পড়েনি। তবু সে হেঁটেছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। শরীরে বল ছিল না। টানা কয়েকদিনের ধকলে। এত লড়াই চালিয়েও মেয়েটি কিন্তু তার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছতে পারেনি। বাড়ির কাছেই এক কিলোমিটার দূরে এসে রাস্তাতেই মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছে। মুখ দিয়ে কাতর আর্তি বেরিয়ে এসেছে। যখন সবাই মেয়েটির কাছে এসেছে তখন সে চিরতরে লকডাউনে চলে গিয়েছে। সত্যিই বড় দুর্ভাগা মেয়েটি। তার কথা কেউ জানতেও পারল না। খবরও হল না। হবেও না কোনওদিন।

আজ যে মায়ের অসহায় ছবি আমাদের সামনে এল তা কিন্তু একমাত্র এনডিটিভি-র জন্যই। ধন্যবাদ জানাই এই চ্যানেলটির প্রধান কর্মকর্তাকে। ধন্যবাদ জানাই ওই নিউজ প্রডিউসারকে। কুর্নিশ জানাই সেই সাংবাদিক বন্ধুটিকে যিনি এমন সাহসী সংবাদ লকডাউনের বাজারে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। যারা বলে চলেছেন সব ঠিক আছে। দেশে রাজ্যে খাবার পর্যাপ্ত আছে। কারও কোনও সমস্যা হচ্ছে না। আর একথা সমানে কিছু সংবাদ মাধ্যম সমানে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।অথচ এনডিটিভি কিন্তু আসল সত্যটা সামনে নিয়ে এল প্রমাণ সহকারে। তারা দেখিয়ে দিল এই সমাজের এই দেশে এক মায়ের কী অসহায় অবস্থা। দেখিয়ে দিল সাত-মাসের সেই সন্তান-সম্ভবা মায়ের হার না মানা লড়াইয়ের ছবি।

পুলিশ থেকে প্রশাসন সকলের কাছে সাহায্যের প্রার্থনা করেও কোনও ফল হয়নি। অবশেষে সামান্য কিছু টাকা আর সামান্য খাবার নিয়েই নবি মুম্বই থেকে মহারাষ্ট্রের বুলধানা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথ হাঁটা শুরু করেছেন। হাঁটতে হাঁটতেই তিনি এনডিটিভি-র সাংবাদিককে বলছিলেন – ” কী করব মুম্বই থেকে। সেখানে কিছুই নেই। না আছে খাবার না আছে থাকার জায়গা। তাই তো বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি।টিভি চ্যানেলটি দেখাল এদের দলে আরও অনেকেই আছেন। আছেন কত ছোট ছোট ছেলে-মেয়েও। সকলের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে অসহায়তা।

ভাবতে অবাক লাগে- একদিন আগে খুলে দেওয়া হয়েছে মদের দোকান। মদ কিনতে কত হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। লাইনে দাঁড়িয়ে শুরু ধাক্কাধাক্কি। এই বেলায় কী সোশ্যাল ডিসট্যান্স মানা হচ্ছে? কোনও উত্তর আছে কর্তাদের কাছে। সমস্ত টিভি চ্যানেল সংবাদপত্রের ফোকাস এইসব মদের দোকানগুলির দিকে। রাজস্ব আসছে। মাতালদের দাপাদাপি বাড়ছে। উছৃঙ্খলতা বাড়ছে। বাড়ছে অসভ্যতামি। বাড়ছে দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যাও। তবু নির্বিকার সকলে।

কোথাও কোনও এক অভিনেত্রী মা তার সদ্যোজাতকে নিয়ে ছবি ট্যুইট করেছেন। আর সেটাও চলে এসেছে খবরের শিরোণামে। অথচ মহারষ্ট্রের এই অচেনা গ্রামের এক সন্তান-সম্ভবা মায়ের আর্তি কারও কাছে পৌঁছলো না। যে মা নতুনকে জাগ্রত করে-যে মা আলো দেখায়-যে মা নতুন করে বাঁচার পথ দেখায়-যে মা সন্তানকে আগলে রাখে দুধেভাতে- যে মা বটগাছের মতো ছায়া দেয় সন্তানকে, আজ সেই মা-ই বিপন্ন। বড় অসহায়। আমরা আরাধনা করি মায়ের। অথচ সেই মায়ের চোখেই আজ জল। সাত মাসের সন্তানকে গর্ভে নিয়ে ইচ্ছাশক্তি সম্বল করেই তিনি হেঁটে চলেছেন। তার প্রতি কী কিছুই করার নেই। এত বড় দেশে একজন সন্তান-সম্ভবা মা’কে এভাবে কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে। আর কেউ এই পরিস্থিতিতেও তাদের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ আবার কিছু মানুষকে খাবার বিলি করে সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে বাহবাও কুড়োচ্ছেন।কোথায় আছি আমরা, বলতে পারেন!

লেখক পরিচিতিঃ প্রধান সম্পাদক- সংবাদ প্রভাকর টাইমস

Published on: মে ৬, ২০২০ @ ২২:৫৭

 

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − 14 =