ঢাকুরিয়ার বুদ্ধ মন্দির ‘নিপ্পনজান মাইহোজি’- দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রথম শান্তি-স্তূপে মহাসমারোহে বুদ্ধজয়ন্তী উদযাপন

Main দেশ ধর্ম ভ্রমণ রাজ্য
শেয়ার করুন

Published on: মে ৫, ২০২৩ @ ২৩:৪৯
Reporter: Aniruddha Pal

এসপিটি নিউজ, কলকাতা, ৫ মে: দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রথম শান্তি-স্তূপ ঢাকুরিয়ার বুদ্ধ মন্দির ‘নিপ্পনজান মাইহোজি’ মহাসমারোহে উদযাপন করল বুদ্ধজয়ন্তী উৎসব। এই মন্দিরটি ‘সিটি অব জয়’ কলকাতা শহরের সহনশীলতা ও বৈচিত্র্যের প্রতীক। শান্তির পীঠস্থান।

ঢাকুরিয়ায় লেক রোডে অবস্থিত নিপ্পনজান মায়োহোজি

দক্ষিণ কলকাতায় ঢাকুরিয়ায় লেক রোডে অবস্থিত নিপ্পনজান মায়োহোজি বা জাপানি বৌদ্ধ মন্দির। ১৯৩৫ সালে নিচিদাতসু ফুজি এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উনি ছিলেন ভগবান বুদ্ধের অনুগামী। নিচিদাতসু ফুজি ছিলেন মহান জাপানি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী নিচিরেনের একজন শিষ্য, যিনি লোটাস সূত্রের মত পোষণ করতেন।

জাহাজে করে কলকাতা আসেন নিচিদাতসু

লোটাস সূত্র হল বুদ্ধের জীবনের শেষের দিকের শিক্ষার একটি সংকলন, যা জ্ঞান অর্জনের একমাত্র উপায় ছিল। নিচেরেনের স্বপ্ন ছিল যে লোটাস সূত্র ভারতে প্রচার করা হবে।আমাদের যেমন অদ্বৈতবাদ ঠিক তেমন। নিচিদাতসু ভারতে বৌদ্ধ ধর্মকে ফিরিয়ে আনার চিন্তাভাবনা করেন।১৯৩৪-৩৫ সালে উনি জাহাজে করে কলকাতা আসেন। কলকাতা তখন ভারতের রাজধানী। খিদিরপুর ডক এলাকায় এখনও জাপানি কুঠি বলে একটা কুঠি আছে। তিনি সেখানে আসেন। এরপর তাঁর যাতায়াত ছিল এই স্থানে। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন জায়গাটা খালি পড়ে আছে।

জুগল কিশোর বিড়লার দান করা জমিতে গড়ে ওঠে বৌদ্ধ মন্দির

ইতিমধ্যে বিড়লাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলতে থেকে। তারপরই গুরুর স্বপ্নপূরণ করতে এবং ভারতে বৌদ্ধধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে ১৯৩১ সালে তিনি কলকাতা আসেন। ১৯৩৫ সালে বলদেওদাস বিড়লার পুত্র শিল্পপতি জুগল কিশোর বিড়লার দান করা জমিতে জাপানি বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করেন।

মন্দিরের প্রবেশদ্বারে, পিলারে, ভিতরে লেখা আছে- “না – মু – ম্যো – হো – রেন – গে – ক্যো।” অনুবাদের অর্থ হল “আমি পদ্মফুল সূত্রের বিস্ময়কর আইনের আশ্রয় নিই।”

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় শান্তি স্তূপের প্রথম সূচনা কলকাতায়

কথা হচ্ছিল স্থানীয় বাসিন্দা পর্যটনপ্রেমী এবং মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত বিলোলাক্ষ দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন- “জাপানি এই বৌদ্ধ মন্দিরটি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যত শান্তি স্তূপ আছে- যার মধ্যে ভারত, নেপাল, ভুটান যেখানে যত শান্তি স্তূপ আছে তার মধ্যে  প্রথম শুরু কিন্তু কলকাতার এই স্থান থেকেই। এই ধরুন ভূবনেশ্বরে ধবলগিরি আছে, রাজগীর আছে, দিল্লিতে আছে, ওয়ার্ধাতেও আছে। এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর খুব ভাল কথাবার্তা হতো। গান্ধীর সঙ্গে শান্তি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। ওয়ার্ধাতে শান্তি স্তূপ প্রতিষ্ঠা হয়। এই ভাবেই এর সূচনা হয়।”

“ঘুরতে ঘুরতে এখানে আসা। ভালো লাগার জায়গাটা হচ্ছে কলকাতা শহরের মধ্যে এমন শান্ত জায়গা নেই। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এখানে পজিটিভিটি এত হাই। এখানে দায়িত্বে থাকা গুরুজির নাম কুশলা ভানতে।” বলছিলেন ট্রাভেল এজেন্টস ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া বা টাফি’র সেক্রেটারি বিলোলাক্ষ দাস।

মঠের দায়িত্বে জাপানি সন্ন্যাসীরাই

এখানে জাপানি সন্ন্যাসীরাই দীর্ঘদিন ধরে আসতেন। এটা জাপানি সন্ন্যাসীদের অধীনেই আছে। এখানে দায়িত্বে আছেন কুশল ভান্তে। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা যখন বোমা ফেলে তখন ব্রিটিশ সরকার জাপানিদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগে। সেইসময় তারা এদের তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তখন তারা চলে যাবার সময় এই মঠটিকে মহানির্বাণ মঠের হাতে চাবি দিয়ে যান। তারাই তখন মঠটিকে দেখভাল করেন। রক্ষা করেছিলেন প্রায় চার-পাঁচ বছর। তারপর পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর তিনি আবার ফিরে আসেন কলকাতায়। মঠের দায়িত্বে জাপানি সন্ন্যাসীরাই রয়েছেন।

মন্দিরটির বর্ণনা

জাপানি বৌদ্ধ মন্দিরটি সোনালী বর্ডার সহ একটি দুই স্তর বিশিষ্ট দুধ সাদা কাঠামো নিয়ে গঠিত এবং একটি স্তূপের মুকুট রয়েছে। প্রতিটি স্তরের কোণে একই রকম ছোট স্তূপ রয়েছে। একটি বর্ধিত পোর্টিকো আছে এবং একটি ছোট ফ্লাইট আলোড়নও মন্দিরের অভ্যন্তরের দিকে নিয়ে যায়।

ভিতরে উপবিষ্ট বুদ্ধের একটি মার্বেল মূর্তি রয়েছে এবং বেদীটি রঙিন কাপড় এবং পিতলের প্রদীপ দিয়ে সজ্জিত। খাদ্য নৈবেদ্যও বেদীতে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা শান্ত।ছাদ থেকে সুন্দর ল্যাম্প শেড ঝুলানো হয়েছে এবং দেয়ালগুলি সুন্দর প্রবাহিত জাপানি ক্যালিগ্রাফি সহ স্ক্রোল দিয়ে বিন্দুযুক্ত। এছাড়াও দেওয়ালে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা নিচিদাতসু ফুজির একটি ছবি ঝুলানো হয়েছে।

সন্ন্যাসীদের কোয়ার্টারগুলি মন্দিরের পিছনে অবস্থিত এবং সামনের অংশে একটি সুন্দর সুন্দর বাগান রয়েছে।উদ্যানটি উজ্জ্বল সোনালী রঙে সুন্দর জাপানি ক্যালিগ্রাফি সহ একটি সুন্দর স্তম্ভ নিয়ে গঠিত। এটি সম্ভবত শান্তির বার্তা বহন করে। স্তম্ভটি একজোড়া সোনালী রঙ-এর সিংহ দ্বারা সুরক্ষিত।

ঢোল পিটিয়ে এবং মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রার্থনা শুরু

আপনি এখানকার গুরুজির সঙ্গে কথোপকথন শুরু করতে পারেন এবং জীবন সম্পর্কে জানতে পারেন। একই সঙ্গে, মন্দিরটি বেশ শান্তিপূর্ণ, এবং শান্ত, পাশাপাশি শান্ত পরিবেশের সন্ধানকারী লোকেরা যে কোনও সময় এই মন্দিরটি দেখতে পারেন।সকাল-সন্ধ্যা প্রার্থনা শুরু হয় বড় ঢোল পিটিয়ে এবং মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে। জাপানি বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে শান্তি এবং জ্ঞানের সন্ধানকারী যে কারোরই পরিদর্শন করা উচিত।

উদযাপনের দুটি বিশিষ্ট দিন

এখানে উদযাপনের দুটি বিশিষ্ট দিন রয়েছে। একটি হল ১৮ ফেব্রুয়ারি বার্ষিকী, একটি জমকালো উদযাপন যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সন্ন্যাসীরা অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন। অন্যটি হল বুদ্ধ পূর্ণিমা – এই সময় মন্দিরটি সারাদিন খোলা থাকে।

 

Published on: মে ৫, ২০২৩ @ ২৩:৪৯


শেয়ার করুন