জেরার মুখে ড. সুরুতা জানালেন-ওদের নির্দেশে বিপুল অর্থের বিনিময়ে নেতাজির ডেথ রিপোর্টে সই করেছিলেন তিনি

Main দেশ বিদেশ রাজ্য
শেয়ার করুন

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস-কে নিয়ে আলোচনা-বিতর্কের শেষ নেই। তাই ১২৫ বছর পরও তাঁকে নিয়ে ভারতবাসীর উৎসাহ-আবেগে এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। শুধু একটাই খেদ- তা হল, এত বছর পরেও নেতাজির মৃত্যু ঘিরে বিতর্ক আজও রয়ে গেল। তাঁর পরাক্রম, বীরত্ব, আদর্শ এসব নিয়ে আমরা গালভরা কথা বললেও আজও তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হল না। দেশ স্বাধীন হলেও নেতাজি দেশে ফিরলেন না নাকি তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হল না। নেতাজিকে কেন এত ভয় ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি আমরা। সংবাদ প্রভাকর টাইমস তাই অনুসন্ধানমূলক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। আজ তাঁর তৃতীয় পর্ব।
Published on: জানু ২৫, ২০২১ @ ১২:২৩
লেখক- সুমিত গুপ্ত 

নেহেরু জানতেন আইএনএ-র বিপুল সম্পত্তির নাগাল পেতে হলে নেতাজীর একদা ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের অন্তত কয়েকজনকে নিজের দলে টানা একান্তই দরকার। যাঁরা সাড়া দেবেন ভালো আর যাঁরা সারা দেবেন না কিংবা গোলমাল পাকাবেন ভবিষ্যতে অবস্থা বুঝে তাঁদের জন্য থাকবে আলাদা ব্যবস্থা। এই ছিল নেহেরুর প্ল্যান।

সেই রাস্তাতেই তিনি চিরকাল হেঁটেছিলেন। তাই এস এ আইয়ার, হাবিবুর রহমান আর কর্ণেল শাহনাওয়াজ খানকে তিনি নানাভাবে পুরস্কৃত করেছিলেন। আর মথুরর মুলিঙ্গম থেবরের মতো এক গুঁয়ে নেতাজি ভক্তের কপালে জুটেছিল অস্বাভাবিক মৃত্যু। তিনি ছিলেন অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ১৯৫৬ সালে শাহনোয়াজ কমিটির সাজানো দরবারে তিনি বেয়াড়া প্রশ্ন করেছিলেন। শিখিয়ে দেওয়া সাক্ষ্যের বুলি আওড়াননি। তিনি শুধু চেয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধীর তালিকায় নেতাজির নাম আছে কিনা জাতীয় মহাফেজখানা থেকে সেই তথ্য প্রকাশ করুক ভারত সরকার। কমিটিতে সাক্ষ্য শেষ হবার পরেই গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন বন্দি থাকার সময় হয় ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পরেন থেবর।অথবা অসুস্থ করে দেওয়া হয় তাঁকে। জেলের সেল থেকে বেরিয়েই তাঁর মৃত্যু হয়।

প্রায় একইভাবে ১৯৭০ সালে খোসলা কমিশনে হাজিরা দেবার পরই কারারুদ্ধ হন আইএনএ-র চিকিৎসক ড. রামচন্দ্র রাও। জেলের মধ্যেই তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়।আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধীর তালিকায় নেতাজির নাম থাকার বিষয়টি নিয়ে খোসলা কমিশনে জলঘোলা করতে চেষ্টা করেছিলেন আরও একজন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধপরাধীর তালিকা ঘোষণা প্রসঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সই করেছিল ভারত। সেই তালিকায় নেতাজির নাম আছে কিনা জানতে চেয়েছিলেন ড. নীহারেন্দ্র দত্ত মজুমদার। পরবর্তীকালে তাঁর কি হয়েছিল এই প্রতিবেদকের জানা না থাকলেও, প্রশ্ন উঠতেই পারে থেবর ও রামচন্দ্র রাওয়ের মৃত্যু কি সত্যিই মৃত্যু নাকি পরিকল্পিত খুন?

প্রসঙ্গের বাইরে হলেও এইবেলা বলি, পাঠক জেনে আশ্চর্য হবেন, ১৯৪৫ সালে ইউনাইটেড নেশনসের জেনারেল অ্যাসেম্বলির একটি প্রস্তাবনায় যুদ্ধপরাধীদের বিচারের একটি সময়-সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে সেই সময়সীমার একটি ডি-লিমিটেশন প্রক্রিয়া চালু করতে একটি চুক্তি সাক্ষর হয় ইউএনও-তে। সেই ডি-লিমিটেশন অনুযায়ী ১৯৭০ সালের পর যদি কোনও যুদ্ধপরাধী ধরা পড়ে তবে তাকে গ্রেফতার করে বিচার করা হবে; এই ছিল প্রতিপাদ্য। চুক্তিটিতে সই দিয়েছিল যে ১২টি দেশ, ভারত ছিল তার অন্যতম।

এসময় আরও একটি কথা বলা জরুরী। ১৯৫১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রতুল চন্দ্র গুপ্তকে আইএনএ-র ইতিহাস রচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু। প্রচুর গবেষণার পর প্রতুলবাবু ৪৮৭ পৃষ্ঠার একটি পান্ডুলিপি তৈরি করেন। নেহেরু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শীঘ্রই প্রকাশিত হবে সেটি। দুঃখের বিষয় , আজও সেটি আর্কেপূরম মিলিটারি আর্কাইভে একটি ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট হয়ে পড়ে রয়েছে।

১৯৫১ সালের ২০শে অক্টোবর কে কে চেট্টুর যে বিস্ফোরক নোট লিখেছিলেন, তাতেই উল্লেখ আছে আইএনএ-র বিপুল সম্পদের ভাগ ভারতে আনার গোপন উদ্যোগ চলছিল ১৯৫২ সালে। গোটা বিষয়টির তদারকিতে ছিলেন স্বয়ং নেহেরু। আইএনএ-র বিপুল সম্পত্তির কি গতি হবে তাই নিয়ে নেহেরু মন্ত্রিসভায় বিতর্ক ছড়িয়েছিল বিস্তর। আবুল কালাম আজাদ চেয়েছিলেন জাপান ফেরত সোনা-দানা অপর্ন করা হোক নেতাজির পরিবারকে। নেহেরি সেকথা শোনেননি। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, নেতাজির পরিবার বিশ্বাসই করে না যে তিনি মৃত। সেই পরিবারকে এক কানাকড়িও নয়। নেহেরুর এই সিদ্ধান্তের থেকে তাঁর একটি বিশেষ মনোভাব আর বার্তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সেটা এই যে, যারাই মেনে নেবে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছে তারাই পাবে লুণ্ঠিত সম্পদের উচ্ছিষ্টামৃত। অন্যরা নয়।

কিন্তু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর তত্ত্বের সঙ্গে আইএনএ-র সম্পত্তির কি সম্পর্ক?

জবাব খুঁজতে চলুন ফিরে যাই ১৯৪৬ সালের মে-জুনে। নেতাজির রাশিয়ায় থাকার উড়ো খবর ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের মারফত গোপন সরকারি সিলমোহর পড়েছে। সিঙ্গাপুর মালয়ে বসে সেই খবর শুনলেন নেহেরু। তিনি প্রমাদ গুণলেন। সর্বনাশ একসঙ্গে অনেক বছর! শেষ রক্ষা বুঝি আর হলো না। কংগ্রেসের পাশাপাশি কাজ করেছেন। সুভাষ কি ধাতুতে গড়া তিনি তা ভালোই জানেন। সুভাষ বেঁচে থাকবে অথচ দেশকে বিদেশি শাসনের শৃঙ্খল মুক্ত করতে শেষ চেষ্টাটুকু করবে না, এমন আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনও কারণই খুঁজে পেলেন না নেহেরু। একবার যদি সুভাষ কোনওভাবে ভারতের মাটিতে পা দেয়, একা আসবে না নিশ্চয়ই। অত কাঁচা কাজ স্ট্যালিন তাঁকে করতে দেবেন না। যদি বা নাও আসে সুভাষ , যদি সে রাশিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়েও আত্মপ্রকাশ করে, দেশবাসীকে আর রাখা যাবে না। দেশের প্রতিটি ঘরের শৌর্য্যের দুয়ার খুলে যাবে। আকাশে ঝলসে উঠবে ‘জয় হিন্দ’-এর কোটি কোটি মুক্তিসূর্য। নিমেষে সব আশা-আকাঙ্খা খড়-কুটো হয়ে উড়ে যাবে।

এদিকে আইএনএ-র সম্পদ জাপান থেকে ভারতে আনার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছেন নেহেরু। জাল গুটিয়ে এনেছেন নিপুনভাবে। পিছিয়ে আসার কোনও জায়গা নেই। এরই মধ্যে সুভাষ যদি দেশে ফেরে, হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাবে। পাগলের মতো বাঁচার উপায় খুঁজতে শুরু করলেন নেহেরু। ঠিক তখনই তাঁর কানে যেন ভেসে এল জেনকিন্সের কথাগুলো, “মেক বোস পারমানেন্টলি ডেড।” মুহূর্তে মনস্থির করে ফেললেন নেহেরু। জুয়ো যদি খেলতেই হয় তো এই মোক্ষম সময়। মাছের তেলে মাছ ভাজার এক জটিল ফন্দি এঁটে ফেললেন তিনি।

দিন পঞ্জিগুলো একটু লক্ষ্য করুন প্রিয় পাঠক- ১৯৪৬ সালের মে-জুন ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল ইন্টেলিজেন্সের অনুরোধে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা গোপনে তদন্ত করে জানলেন নেতাজি রাশিয়ায় বেঁচে বর্তে আছেন। আর তার ঠিক পরের মাসেই জাপানে ড. সুরুতা নেতাজির ডেথ রিপোর্টে সই দিলেন। ১৯৯৯ সালে নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের তদন্তে নেমেই সবার আগে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন জাস্টিস মনোজ মুখার্জি। ব্রিটিশ সরকারের এক উচ্চ পদাধিকারী তাতে বলেছিলেন, নেতাজি সংক্রান্ত সবচেয়ে গোপন ফাইলগুলি ২০২১ সালে প্রকাশ করবেন তাঁরা। তখন জোর খটকা লেগেছিল জাস্টিস মুখার্জির। কমিশনের তদন্তের কাজে তৃতীয়বার জাপানে গিয়ে তাঁর সেই খটকার একটা গিট খুলে গেল। নেতাজির মৃত্যুর রিপোর্টে সই-দানকারী প্রথম চিকিৎসক ড. সুরুতাকে জেরা করে তিনি বুঝতে পারলেন, ১৯৪৬ সালের মার্চে মালয়ে গিয়ে দাবার কোন চাল সাজিয়ে গিয়েছিলেন নেহেরু। জাস্টিস মুখার্জির জেরার মুখে ভেঙে পড়লেন ড. সুরুতা। স্বীকার করলেন,”ওদের নির্দেশে বিপুল অর্থের বিনিময়ে নেতাজির ডেথ রিপোর্টে সই করেছিলেন তিনি। কিন্তু সুরুতার সেই “ওরা” যে কারা তা আজও অনাবিষ্কৃত।

১৯৪৬-এর মে-জুনে মালয়ে বসে নেতাজির বিরুদ্ধে যে চক্রব্যুহ সাজিয়েছিলেন নেহেরু এবার সেই বহুমুখী আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল। আইএনএ-র সমস্ত সম্পত্তির সর্বাধিকারী ছিলেন নেতাজি স্বয়ং। নেতাজির মৃত্যুর তত্ত্বে কাগজে-কলমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আইনি সীলমোহর লাগাতে পারলে সম্পত্তি দাবি করার কেউ থাকবে না, এক যদি না সুভাষ সশরীরে স্বপরিচয়ে কোনও দিন ফিরে আসেন। সুতরাং সুভাষের ঘরে ফেরার সব পথও বন্ধ করতে হবে অবিলম্বে। তড়িঘড়ি দেশে ফিরলেন নেহেরু।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু থেকেই কেজিবি-র কার্যকলাপের শক্ত ঘাঁটি ছিল বম্বে। ১৯৪৬ সালের জুলাই-এ নেহেরু বম্বে পৌঁছলেন। কেজেবি এজেন্ট সৈয়দ ইয়ানোৎসকে খুঁজে বের করে তার হাতে স্ট্যালিনের উদ্দেশ্যে একটি গোপন চিঠি লিখে পাঠালেন তিনি। তবে শুধু স্ট্যালিনের ‘সদিচ্ছা’র ভরসায় বসে থাকার পাত্র নেহেরু ছিলেন না। সুভাষের নাম আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধীর তালিকায় না তুলতে পারা পর্যন্ত পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না নেহেরু। সেজন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হল আরও দু’মাস। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে রুশ পার্টি কংগ্রেসের আমন্ত্রণ সেরে কলকাতা ফিরলেন কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ লাহিড়ি। ফিরে এসে দলের সতীর্থদের সোমনাথবাবু জানালেন, তিনিও “তাঁকে” স্বচক্ষে দেখে এসেছেন। খবরটা কানে আসতেই নাড়ি ফের চঞ্চল হয়ে উঠল নেহেরুর। কিন্তু অপেক্ষার তখনও মাস দেড়েক বাকি।

১৯৪৬ সালের ২রা সেপ্টেম্বর, ভারতের প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়ী হয়েই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলিকে চিঠি পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু। সুভাষের নাম জুড়ল আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধীর তালিকায়। প্রকাশ্যে ভারতে ফেরার পথ সমস্ত দিক দিয়ে চিরতরে বন্ধ হল। চক্রান্তে বড়সড় সাফল্য পেলেন নেহেরু। চওড়া হাসি ফুটল ব্রিটিশ প্রভুদের মুখে। কিন্তু বিধির লিখন যে অমোঘ। তাকে খন্ডায় কে।ক্রমশঃ

Published on: জানু ২৫, ২০২১ @ ১২:২৩


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

− 1 = 1