নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস-কে নিয়ে আলোচনা-বিতর্কের শেষ নেই। তাই ১২৫ বছর পরও তাঁকে নিয়ে ভারতবাসীর উৎসাহ-আবেগে এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। শুধু একটাই খেদ- তা হল, এত বছর পরেও নেতাজির মৃত্যু ঘিরে বিতর্ক আজও রয়ে গেল। তাঁর পরাক্রম, বীরত্ব, আদর্শ এসব নিয়ে আমরা গালভরা কথা বললেও আজও তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হল না। দেশ স্বাধীন হলেও নেতাজি দেশে ফিরলেন না নাকি তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হল না। নেতাজিকে কেন এত ভয় ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি আমরা। সংবাদ প্রভাকর টাইমস তাই অনুসন্ধানমূলক ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। আজ তাঁর চতুর্থ পর্ব।
Published on: জানু ২৬, ২০২১ @ ১৮:৩৮
লেখক- সুমিত গুপ্ত
পর্ব-চার
পরবর্তীকালে সময়ের সাথে সাথে সুভাষ বোসের জীবন্ত প্রচ্ছায়া যতই দীর্ঘ হয়েছে, একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সেই ছায়াকে ডিঙিয়ে যাওয়া নেহেরুর পক্ষে ততই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। যত সহজে তিনি তাঁর ব্রিটিশ ও মার্কিন মিত্রদের ভরসা আর সহযোগিতা পকেটস্থ করতে পেরেছিলেন, সোভিয়েতের সর্বময় কর্তা স্ট্যালিনের বেলায় সেটা মোটেও হয়নি। কোনও এক অজানা কারণে নেহেরু ক্ষমতায় আসার পর থেকে স্ট্যালিন তাঁকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। ১৯৪৬ সালের মে মাসেই ব্রিটিশ গোয়েন্দারা নেহেরু সরকারকে জানিয়ে দিয়েছিল, নেতাজি বহাল তবিয়তে রাশিয়ায় রয়েছেন।
রাশিয়ায় মিলিটারি আর্কাইভ থেকে পরবর্তীকালে কৌশলে ড. পূরবী রায় জানতে পেরেছিলেন শুধু সে মাসেই নয় ওই বছরের অক্টোবরেও নেতাজিকে নিয়ে ভরোশিলভ, মিখোয়াম, মলোটভ প্রমুখ রুশ নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন স্ট্যালিন। চন্দ্র বোসকে নিয়ে তাঁর বিশেষ কোনও পরিকল্পনা ছিল। যা নেহেরুর সঙ্গে তিনি কোনও মতেই ভাগ করতে চাননি। এর ফলে নেতাজিকে নিয়ে নেহেরুর অস্বস্তি চরমে পৌঁছেছিল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্ট্যালিন নেহেরুকে রাশিয়ায় পা ফেলতেই দেননি। অগত্যা অপেক্ষা করা ছাড়া নেহেরুর আর কিছুই করার ছিল না।
১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর নেহেরুর বরাত ফিরতে শুরু করল। নেহেরু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। রাশিয়ায় ব্যাপকভাবে ডি-স্ট্যালিনাইজেশন শুরু করলেন ক্রশ্চভ-বুলসানিন জুটি। যে দেশে সুভাষ বসে আছে সেই দেশের সঙ্গে কোনওরকম কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরির আগে দশবার ভাবতে হচ্ছিল নেহেরুকে। আরও দুটো বছর প্রায় দম বন্ধ করে ঘাপটি মেরে বসে রইলেন নেহেরু। ১৯৫৪ সালে অবশেষে এল সেই দিন। সুভাষকে নিয়ে চূড়ান্ত একটি আপোষ রফায় বসলেন ক্রশ্চভ-নেহেরু। সেই কলঙ্কিত আপোষ রফার বুনিয়াদেই মূলত তৈরি করা হল রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির রূপরেখা। ১৯৫৫ সালে মধুরেণ সমাপয়েত। ওই বছর রুশ সফরে গেলেন নেহেরু। ক্রশ্চভ এলেন ভারতে।সেদিনের সেই মৈত্রী চুক্তির সাদা ফুলের তোড়ার আড়ালে যে জঘন্য প্রতিহিংসা আর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার লালসা নিবৃত্তির নরক গুলজার খেলে বেড়িয়েছিল একদিন না একদিন তা প্রকাশিত হতোই। আর হলোও তাই।
১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরের এক সকাল। অকুতোভয় নেতাজি নেতাজি গবেষক ড. পূরবী রায় মস্কোয় দেখা করলেন তাঁর ইনস্টিটিউট অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের প্রাক্তন সহকর্মী, বন্ধুপ্রবর আলেকজান্ডার কোলেশনিকভের সঙ্গে। কর্মসূত্রে কোলেশনিকভ ছিলেন সোভিয়েত আর্মির প্রাক্তন জেনারেল। রুশ সেনাবাহিনীতে তাঁর বেশ প্রতিপত্তি ছিল। সেই প্রভাব খাটিয়ে কোলেশনিকভ অসাধ্য সাধন করলেন।
মস্কোর কাছাকাছি পোডোলস্ক নগরীর মিলিটারি আর্কাইভ থেকে চন্দ্র বোস সংক্রান্ত একটি অতি গোপন ফাইলের তথ্য সংগ্রহ করে জানলেন ড. রায়ের জন্য। সেই তথ্য বলছে, ১৯৫৬ সালে সোভিয়েতের ২০তম পার্টি কংগ্রেসের আলোচনায় একটা বড় অংশ জুড়ে বসেছিল চন্দ্র বোসকে নিয়ে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতাদের দীর্ঘ ও গুরুতর আলোচনা।
কি ছিল সেই আলোচনার বিষয়?
সেই আলোচনার টেবিল থেকে ছিটকে আসা ঠিক কতটা কালি প্রত্যেক ভারতবাসীর ঘাড়ে-গায়ে মাখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন নেহেরু? অজান্তে যে পাপের বোঝা আজও হয়তো আমরা বয়ে চলেছি! ভেবে দেখুন একবার, কী অদ্ভূত সমাপতন, এই সেই ১৯৫৬ সাল, যে বছর শাহনাওয়াজ কমিটি বসিয়েছিলেন নেহেরু। ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে পোডোলস্কোর মিলিটারি গু’র আর্কাইভের গোপন নথির তথ্য হাতে পেয়ে ড. রায় সেদিন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন সুভাষকে নিয়ে যে গোপন ডিল সম্ভবত রুশ-ভারতের মধ্যে সেদিন হয়েছিল, তার গোড়ায় পৌঁছনো অত সহজ হবে না। হয়ওনি সেটা। ঘটনাচক্রে সেই সময় পি এ সাংমার নেতৃত্বে ভারতীয় সাংসদদের একটা দল রাশিয়া ভ্রমণে গিয়েছিল। সেই দলে ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের হেভিওয়েট নেতা চিত্ত বসু। সরল বিশ্বাসে তাঁর কাছে সমস্ত কাগজপত্র দিয়ে নেতাজির রুশ-পরিযান পর্বের সমস্ত রহস্য সন্ধানে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। বান্ধবীর হয়ে কোলেশনিকভও চিত্তবাবুর কাছে একই অনুরোধ রেখেছিলেন।
নেতাজির হাতে গড়া দলের সর্বাসর্বা হয়েও ড. পূরবী রায়ের সেই নিঃস্বার্থ আবেদনকে ফলপ্রসু করতে পারেননি কমরেড চিত্ত বসু। নাকি তাঁর চেষ্টাকে আমলই দেওয়া হয়নি নাকি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল তা জানা যায়নি। সত্যি বড় দুর্ভাগা আমাদের দেশ। ড. রায়ের আবেদন তিনি কোনওদিনই রাখেননি। সাত বছর পর নতুন করে আবার একবার জেগে ওঠে আশার আলো। যে সত্য ষড়যন্ত্রের পাহাড়ের তলায় চাপা পড়ে হারিয়ে যেতে বসেছিল, পাথরের বুক ফাটিয়ে ফের তা উঁকি দিতে থাকে। ২০০৩ সালে তখন নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের তদন্ত করছে মুখার্জি কমিশন। ড. রায়ের অসমসাহসিক লড়াইয়ের কথা কিভাবে যেন জানতে পারলেন জাস্টিস মুখার্জি। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ঐ বছরই ড. রায়কে সঙ্গে নিয়ে রাশিয়া রওনা হলেন জাস্টিস মুখার্জি। দুর্ভাগ্য তাঁর রাশিয়ায় পৌঁছনোর আগেই কোলেশনিকভকে একটি বিশেষ কাজের দায়িত্ব দিয়ে তুরস্কের আঙ্কারায় পাঠিয়ে দিয়েছিল রুশ সরকার। কোলেশনিকভের আঙ্কারা যাত্রা একটি স্বাভাবিক ঘটনা ছিল নাকি ১৯৫৬ সালের রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির ফলশ্রুতি তা অবশ্য জানা যায়নি।
ড. রায়ের প্রধান সাক্ষীকে না পেয়ে বাধ্য হয়ে একরকম খালি হাতেই ফিরতে হল জাস্টিস মনোজ মুখার্জিকে। কিন্তু এতদিনে তিনি বুঝে ফেলেছিলেন, যে পুকুরে তিনি নেমেছেন তার তল নেই। দীর্ঘ ১২ বছর পর কোলেশনিকভ রাশিয়ায় ফিরেছিলেন ২০১৫ সালে। ফিরেই সাংবাদিক বৈঠক করে তিনি জানিয়েছিলেন ড. পূরবী রায়ের সব কথা সত্যি। অবিলম্বে রুশ ও ভারত সরকারকে আলোচনায় বসে নেতাজির রহস্যের মীমাংসা করার দাবিও তিনি জানিয়েছিলেন। দিল্লির মসনদে বসার প্রথম দিনেই নেহেরু বুঝেছিলেন তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্ব নেতাজির বিপদ এড়ানোর জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ, মানুষ তা কোনওদিন বিশ্বাস করেনি, করবেও না। সেই কারণে বিকল্প আরও তিনটি বাঁচার রাস্তা তিনি তৈরি করে রেখেছিলেন।
এক- আন্তর্জাতিক যুদ্ধপরাধীর তালিকায় সুভাষের নামের চির-অন্তর্ভুক্তি;
দুই-রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি;
তিন- বিভিন্ন সময়ে নেতাজির বিভিন্ন প্রতিকল্প তৈরি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা।
তৃতীয় এই বিকল্পটি তাঁর মাথায় ঢুকিয়েছিলেন ১৯৫১ সালে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কর্তা ভোলানাথ মল্লিক। নেতাজি আতঙ্কে জেরবার নেহেরু একবার ভোলানাথবাবুর শরনাপন্ন হয়েছিলেন। ভোলানাথবাবু তখন তাঁকে বলেছিলেন, “মেক টেন ডামিজ”। প্রতিবেদকের স্থির বিশ্বাস, শৌলিমারির সাধুবাবা, ফৈজাবাদের বাবাজি, ভগওয়ানজি, গুমনামিবাবারা হয়তো সেই পথ ধরেই এসেছেন। আইএনএ-র লুন্ঠিত সম্পদ যেভাবে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বকে বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বকে জ্বালানি জুগিয়ে এসেছে, একইভাবে সেই সম্পদ সম্ভবত নেতাজিরূপী এইসব বাবাদেরও তৈরি করেছে। সময় হলে এ সত্য একদিন প্রমাণ হবেই। ক্রমশঃ
Published on: জানু ২৬, ২০২১ @ ১৮:৩৮