গঙ্গাসাগর কেন টানে তীর্থযাত্রীদের, কি আছে সেখানে, কি তার ইতিহাস জানতে চান-পড়ুন তাহলে

দেশ ভ্রমণ রাজ্য
শেয়ার করুন

লেখক-তারকব্রহ্ম দাস ব্রহ্মচারী

Published on: জানু ১২, ২০১৮ @ ১৫:১১

ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতি ও সাহিত্যে গঙ্গাসাগর সঙ্গম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মহাতীর্থ। অতি প্রাচীন কাল হতেই অধ্যাত্ম পথের সাধক, মুনিঋষি, সাধুসন্তগণ গঙ্গার তটভূমিতে আশ্রয় নিয়ে তারা তাদের পরম প্রাপ্তি লাভ করেছেন। অগণিত মঠ, মন্দির, দেবালয়, তীর্থক্ষেত্র গড়ে উঠেছে গঙ্গার উভয়তীরে। গঙ্গা তীরে যাগ-যজ্ঞ, শাস্ত্রপাঠ, দান, তপস্যা, জপ, শ্রাদ্ধকৃত্য, দেবতা পূজন যা কিছু অনুষ্ঠিত হয় তা কোটিগুণ ফল প্রদান করে। তাই গঙ্গার পবিত্রতায় আকৃষ্ট হয়ে পরমাকর্ষণে সাধুসন্তরা আশ্রয় গ্রহণ করেন গঙ্গার পুণ্য তটভূমিতে। মহর্ষি কপিল দেবের সাধনার পাদপীঠ গঙ্গাসাগর সঙ্গম। এই সুপ্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্র সাধুসন্ন্যাসী ও ধর্মপ্রাণ মানুষের এক মহান তীর্থস্থান। বঙ্গদেশের ভৌগলিক সীমারেখার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত নদী ও সমুদ্র বিধৌত নিম্নভূমিই গঙ্গাসাগর সঙ্গম নামে পরিচিত। এখানেই ধ্যানরত কপিলদেবের হুঙ্কারেই সগর রাজের ৬০ হাজার সন্তান ভস্মীভূত হয়েছিল। সগর সন্তানদের সন্ধানে আগত অংশুমানকে কপিলমুনি বললেন-যদি পুণ্যতোয়া গঙ্গাদেবী এসে এদের অভিষিক্ত করেন তবেই এরা মুক্ত হতে পারবেন। অতঃপর সগররাজ, অংশুমান, দিলীপ বহু তপস্যা করে উর্দ্ধলোক হতে গঙ্গাকে নিয়ে এসে কপিলদেবের আশ্রমের কাছে সাগর তীরে নিয়ে এলে মুনিবর গঙ্গাদেবীকে স্বাগত জানিয়ে সগর সন্তানদের দুর্গতির কথা জানান। ত্রিলোকপাবনী মা গঙ্গাদেবী তখন পবিত্র জল দিয়ে ভস্মীভূত সগর সন্তানদের দিব্য গতি প্রদান করেন। পবিত্র গঙ্গা জলের স্পর্শে সগর সন্তানরা মুক্ত হলেন। এই সেই শুভ্র বালুকাযুক্ত সুবিস্তৃত বেলাভূমি, নিকটে সবুজ বনানী, সীমাহীন সৌন্দর্য্য সম্ভারে সজ্জিত ভূমিই গঙ্গাসাগর সঙ্গম।

গঙ্গাসাগর সঙ্গম মহাতীর্থ একবার বা একদিনের জন্য নয়, গঙ্গাসাগর সঙ্গম নিত্য মহাতীর্থ। কেননা গঙ্গাসাগর মহাতীর্থের মাহাত্ম্য অপরিসীম, অনির্বচনীয় এবং অপরিমেয়। স্কন্দ পুরানে আছে-মানব সকলতীর্থ দর্শন, দান, তপস্যা, দেবপূজা, যজ্ঞাদিতে যে ফল লাভ করেন, তা একমাত্র গঙ্গসাগর সঙ্গমে স্নানে লাভ হয়-“লভতে পুরুষঃ সর্ব্বং স্নাত্বা সাগর সঙ্গমে।” পদ্ম পুরানে আছে-কলিযুগে একমাত্র গঙ্গাকেই আশ্রয় করা কর্তব্য- “কলৌ গঙ্গা সমাশ্রেয়ৎ।” যারা সশরীরে গঙ্গা স্নানে যেতে অসমর্থ তারাও যদি -“গঙ্গা গঙ্গেতি যো ব্রুয়াৎ যোজনাং শতৈরপি। মুচ্যন্তে সর্ব্ব পাপেভ্য বিষ্ণুলোকং স গচ্ছতি।” অর্থাৎ কেউ যদি ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে শত যোজন (৮০০ মাইল) দূরে বসে- “গঙ্গা গঙ্গা” বলে ডাকেন সকল প্রকার পাপ থেকে মুক্ত হয়ে তিনিও ভগবান বিষ্ণুর লোকে গমন করেন।

গঙ্গাসাগর মেলার প্রধান আকর্ষন শ্রীকপিল দেবের মন্দির। শ্রীমন্দিরে কপিলদেব পদ্মাসনে যোগারূঢ় অবস্থায় উপবিষ্ট। তাঁর বাম হাতে কমণ্ডুল, ডান হাতে জপমালা, শিরোদেশে পঞ্চনাগ ছত্রবৎ অবস্থিত। শ্রীকপিল দেবের দক্ষিণে শ্রীগঙ্গাদেবীর বিগ্রহ। ইনি চতুর্ভুজা এবং মকর বাহন। শ্রীহস্ত সমূহে শঙ্খ, পদ্ম, অমৃতকুম্ভ ও বরাভয়। সম্মুখে মহাতাপস ভগীরথ। কপিল দেবের বিগ্রহের বামদিকে সগর রাজ ভক্তি বিনম্র চিত্তে করজোড়ে অবস্থান রত। এই গঙ্গাসাগর সঙ্গমে রবিবার ১৪ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি দিবসে কয়েক লক্ষ পুণ্যার্থী মহাস্নান করবেন। গঙ্গাস্নান, গঙ্গাপুজো, গঙ্গায় তর্প্নাদি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তির সাথে ঐ দিনে অনুষ্ঠিত হবে। গঙ্গাসাগর সঙ্গমে মকর স্নানের বিশেষ মন্ত্র, যথা-

“ত্বং দেব সরিতাং নাথ ত্বং দেবী সরিতাম্বরে।

উভয়োঃ সঙ্গমে স্নাত্বা মুঞ্চামি দুরিতানি বৈ।।”

এ মন্ত্র উচ্চারণ করে স্নান করা অবশ্য কর্তব্য। স্নানের শেষে দান কার্য জরুরী।

জগৎ জীবের উদ্ধারের জন্য ত্রিলোক পাবনী গঙ্গাদেবীর এই জগতে আগমন। তাই আমরা এই মহাতীর্থ গঙ্গাসাগর সঙ্গমে মকর সংক্রান্তির স্নান মহোৎসবের দিনে ত্রিলোক জননী গঙ্গাদেবীর চরণ সমীপে প্রার্থণা করি-“হে মাতঃ গঙ্গে! আপনি এই ভারত ভূমিতে শুভাগমন করে যেমন সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলায় প্রাকৃতিক সম্পদে দেবী বসুন্ধরাকে সমৃদ্ধ করেছেন, ভস্মীভূত সগর সন্তানদের পরম কল্যান বিধান করেছেন, তেমনি-“হে শান্তি সম্পাদন কারিনী! হে প্রণতার্তিহারিণী জগন্মাতঃ! দুঃখ-ক্লেশে লাঞ্ছিত, ত্রিতাপে দগ্ধীভূত, বেদনায় আর্তনাদ গ্রস্ত জীব-জগতের প্রতি আপনার তরঙ্গ থেকে আগত স্নিগ্ধ সমীরণ প্রবাহিত করে তাদের ত্রিতাপে তাপিত হৃদয়ে সুশীতল শান্তির স্পর্শে পরমানন্দের সঞ্চার পূর্বক পরম কল্যান বিধান করুন।

লেখাটি মায়াপুর, ইসকন-এর সৌজন্যে প্রকাশ করা হল।

Published on: জানু ১২, ২০১৮ @ ১৫:১১

 

 


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

+ 47 = 52