সংবাদদাতা- অনিরুদ্ধ পাল
Published on: নভে ৬, ২০১৮ @ ১১:৩০
এসপিটি নিউজ, বিন্দোল, ৬ অক্টোবরঃ চিরাচরিত প্রথায় নিষ্ঠা সহকারে সারা ভারতের যেসমস্ত স্থানে শক্তির আরধনা হয়ে থাকে তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার বিন্দোল গ্রামে মাতৃসাধক তন্ত্রগুরু মহারাজ শ্রী শিশির কুমার শর্মার পুজো ঐতিহ্য-অভিনবত্বে বিশেষ স্থান অর্জন করেছে।এবছর সেই পুজো ৪১তম বর্ষ স্পর্শ করল।বৈষ্ণব মতে এই পুজো দেখার জন্য শুধু দেশ নয় প্রতিবেশী প্রায় সমস্ত দেশ থেকে বহু ভক্ত একত্রিত হন।যা সত্যি দেখার মতো।
স্বপ্নাদেশ অনুসারে প্রতিবছরই বদলায় ষোড়শী ভবতারিণী মায়ের শাড়ি ও গায়ের রঙ।পুজোর ভোগ খেতে আসে আজও শেয়ালের দল। সাতজন পুজারি সহযোগে তারা মাতৃসাধক ও তন্ত্রগুরু শ্রী শিশির কুমার শর্মার মাতৃ আরাধনা দেখতে প্রসাদ গ্রহণ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের বিন্দোল গ্রামে। তারাপীঠের ত্রিনয়নী আশ্রম প্রতিষ্ঠাতা সাধক শ্রী শিশির কুমার শর্মার নিজ বাসভবনে এই ষোড়শী কালীপুজো ৪০ বছরে পা দিল।
বামা ক্ষ্যাপার উত্তরসূরী শ্রী শঙ্কর ক্ষ্যাপার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় শ্রী শিশির কুমার শর্মার। সেই সময় মোক্ষকামী সন্ন্যাসী শঙ্কর ক্ষ্যাপা বাবা প্রথম দর্শনেই অনুভব করেন যে সৌম্যদর্শন যুবরাজ ভিখারীর বেশে উপস্থিত হয়েছেন। শ্রী শঙ্কর বাবা নিজের আসন থেকে উঠে পড়েন। ভক্তদের ডেকে শ্রী শিশির কুমার শর্মাকে দেখিয়ে বলেছিলেন-তোরা দেখে নে, আজ মহাশ্মশানে এসেছে রাজসন্ন্যাসী। বললেন-” তাঁরা নাম কর, তাঁরা নাম কর। পরে তিনি শব সাধনা করে শ্রীগুরুর আশীর্বাদে তন্ত্রসাধক ও শব সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। এই শঙ্কর বাবার জন্মস্থান তারাপীঠে কবিচন্দ্রপুরের। শ্রী শিশির কুমার শর্মা ত্রিনয়নী আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি অমাবস্যা তিথিতে মহাসমারোহে মানব কল্যানে মায়ের পুজোপাঠ যজ্ঞাদি ক্রিয়াকর্ম করে চলেছেন এই আশ্রমে আজকের সময়ে অনিন্দ্যসুন্দরদেবকান্তি দর্শন সাধক পুরুষ শ্যাম ও শ্যামা মায়ের সাধক শিশির কুমার শর্মা। অমন ধীর, স্থির, শান্ত, সংযত, নিষ্পৃহ, মাতৃতৃপ্তি ভক্ত খুব কমি চোখে পড়ে। তাঁর নির্মিত মা মনসা, শ্যাম ও শ্যামা মায়ের মন্দিরেও অসংখ্য ভক্ত ও গুনগ্রাহীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন, তাদের কথা শুনছেন, তাদের নানা ক্রিয়াকর্মের উপদেশ দিচ্ছেন। সেখানে তাদের কোনও ক্লান্তি নেই। সদাহাস্য, উজ্জ্বল, স্বর্ণমুখ দর্শনে ভক্তরা তৃপ্ত। আজকে যখন মানুষ আর্থিক- সামাজিক সংকটে দুর্দশাগ্রস্ত, রাজনৈতিক রোষানলে জর্জরিত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনিষ্ট হতে চলেছে সামাজিক বিষ বাক্যে ধরাধাম কলুষিত তখন এগিয়ে এসেছেন দিশারী অর্থাৎ পথ প্রদর্শক রূপে। একমাত্র তন্ত্র সাধনায় যিনি সর্বশক্তিমান তিনি এগিয়ে এসে মানুষের দুঃখ কষ্ট, জরা-ব্যাধি সমস্ত কিছুতেই শান্তি ও স্বস্তি প্রদান করেছেন এবং করছেন মহারাজের অলৌকিক ক্রিয়াকর্মে ভক্তরা অভিভূত।
উত্তরবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার বিন্দোল গ্রামে শ্রী শিশির কুমার শর্মার প্রতিষ্ঠিত ভিন্ন ধরনের ষোড়শী কালী পুজো হয়ে আসছে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে।ষোড়শী দশ মহাবিদ্যার তৃতীয় রূপ।দশ মহাবিদ্যা হলেন-কালী, তারা, ষোড়শী, ভৈরবী, ভূবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলাকামিনী। মা ষোড়শী ত্রিপুরাসুন্দরী বা ললিত-ত্রিপুরাসুন্দরী , মা ভবানী রূপেও খ্যাত। দেবী এখানে পূর্ণতা ও পূর্ণাঙ্গতার স্বরূপ। শ্রীকূল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবী।
পুরানের কাহিনি অনুসারে দশ মহাবিদ্যার প্রচলন নিয়ে খুব সুন্দর ঘটনা আছে। সেখানে উল্ল্যেখ আছে যে শিব ও তাঁর স্ত্রী পার্বতীর পূর্বাবতার দাক্ষায়নী সতীর মধ্যে এক দাম্পত্যকলহ থেকেই এই দশ মহাবিদ্যার সৃষ্টি। পিতা দক্ষের যজ্ঞে আমন্ত্রণ না পেয়েও সতী যখন সেখানে যেতে চান তখন শিব তাঁকে যেখানে যাওওয়ার অনুমতি দেননি। ক্রুদ্ধ সতী তখন তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে আগুন বের করতে থাকেন। আর সেই আগুন থেকে কালী বা শ্যামায় পরিণত হন। এই অবস্থা দেখে ভীত শিব সেখান থেকে পালাতে গেলে সতী তাঁর দশ মহাবিদ্যার রূপ ধারণ করে চারিদিক দিয়ে শিবিকে ঘিরে ফেলেন। তখন শিব যজ্ঞে যাওয়ার অনুমতি দেন।
আচার্য নিগমানন্দ পরমহংসদেব রচিত তাঁর ‘তান্ত্রিকগুরু’ পুস্তকে তিনি মহাকালী সম্পর্কে সুন্দর বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখছেন-“এই দেবীদ্বারাই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড মুগ্ধ হইতেছে, ইনিই এ বিশ্ব সৃষ্টি করেন, ইহার নিকট প্রার্থনা করিলে ইনি তুষ্টা হইয়া জ্ঞান ও সম্পদ প্রদান করেন। এই মহাকালী কর্তৃক অনত বিশ্ব পরিব্যপ্ত আছে; ইনি মহাপ্রলয়কালে ব্রহ্মাদিকেও আত্মসাৎ করেন এবং খণ্ডপ্রলয়ে ইনিই সমস্ত প্রাণিগণকে বিনাশ করিয়া ফেলেন। সৃষ্টিসময়ে সমস্ত বিষয় সৃষ্টি করেন, আবার স্থিতিকালে প্রাণীদিগের পালন করেন, কিন্তু ইহার কখনই উৎপত্তি হয় না। ইনি নিত্যা, লোকের অভ্যুদয়কালে ইনি বৃদ্ধিপ্রদা লক্ষ্মী, আবার অভাবের সময়ে অলক্ষ্মীরূপে বিনাশ করিয়া থাকেন। ইহাকে স্তব করিয়া পুষ্প, গন্ধ, ধূপাদি দ্বারা পূজা করিলে বিত্তপুত্রাদি দান ও ধর্মে শুভবুদ্ধি প্রদান করিয়া থাকেন। এই মহাশক্তির শরণাপন্ন হইয়া ইহাকে আরাধনা করিতে পারিলে ভোগ, স্বর্গ ও মুক্তি লাভ হইয়া থাকে।”
তন্ত্রগুরু শিশির কুমার শর্মার কথায়-ভবে ভাবে এসেছেন মা ভবানী। চতুর্দশী রাতে পঞ্চমুণ্ডির আসন দশভূজা কষ্টিপাথরের ত্রিমুণ্ডি দেবী পূজা পান। পরদিন অমাবস্যার রাত ১২টায় শিবাভোগ ভৈরবী মন্দিরে হয়। এখানে এখনও শেয়াল এসে এই ভোগ গ্রহণ করে থাকে। ভক্তদের বিশ্বাস দেবী শেয়াল রূপে এসেই এই প্রসাদ গ্রহণ করে থাকেন। এরপরেই শুরু হয়ে যায় মূল মন্দিরের ষোড়শীরূপে মা ভবানীরূপে মা ভবানীর পুজো। পূর্ণযৌবনা ১৬ বছর বয়সি গোলাপি গৃহবধূ চুল ছাড়া, বেনারসী শাড়ি, কোমরে নৃমুণ্ডুমালিনী যা ভ্যানিটি ব্যাগে আবৃত, পদতলে শবরূপী শিব বাবা ভোলানাথ অধিষ্ঠিত। এ এক অনন্যা দেবী। পাশে মা মনসা, বাদিকে শিবমন্দির। এই দেব্দেবীরর পুজো করেন স্ব্যং সাধক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী তারাপীঠের মহারাজ শ্রী শিশির কুমার শর্মা। এখানকার ষোড়শী ভবতারিনী দেবী মা নিজেই স্বপ্নাদেশ দিয়ে থাকেন থাকেন। কী রংযের শাড়ি এবং নিজের গায়েরো। মায়ের আদিরূপ দর্শনের জন্য ঝাড়খণ্ড, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, নেপাল, সহ বিভিন্ন এলাকার বহু মানুষ এদিন বিন্দোলে জমায়েত হন। প্রসাদ পান।এই পুজো দেখাটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার।
Published on: নভে ৬, ২০১৮ @ ১১:৩০